নিজে প্রতিবন্ধী হওয়ায় সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটায় আবেদন করেছে পঙ্গু সোনিয়া। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছে না।
ঝিনাইদহের সদর থানার যাত্রাপুর গ্রামের বাবলুর রহমানের মেয়ে ও কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজের বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সোনিয়া (২৪)। গরীব কৃষক ঘরের মেয়ে সোনিয়া। তারা তিন ভাই বোন সোনিয়া সবার বড় আর দুই ভাই ছোট।
সোনিয়ার এক ভাই টাকার অভাবে পড়াশোনা বাদ দিয়ে মামাদের সহায়তায় গত ১ বছর জমি বিক্রি করে বিদেশে যেয়ে সামান্য বেতনে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে। আর ছোট ভাই সংসারের কাজের পাশাপাশি দশম শ্রেণিতে পড়ে।
সোনিয়া কাঁদতে কাঁদতে জানায়, গত ২০১১ সালের (১৪ ডিসেম্বর) সকালে বিষয়খালীতে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য স্কুরুটারে ওঠার সময় পেছন থেকে একটি পিক-আপ ভ্যান এসে ধাক্কা দেয়। এতে তার দু’পা প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তখন সে বিষয়খালী এসএম স্কুল এন্ড কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়তো। তখন স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর ভর্তি করে তার বাড়িতে খবর দেয়। সদর হাসপাতালের ডাক্তারা বাম পায়ে অবস্থা বেশি খারপ হওয়ার কারনে তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে প্রেরণ করে। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলে। ক্রমেই তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে এজন্য তারা তাকে সমরিতা হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। ঐ সময় তাকে ঢাকা পান্থপথের সমরিতা হাসপাতালের চিকিৎসক আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করাতে থাকে।
চিকিৎসকেরা জানায়, তাকে বাচাঁতে হলে বাম পা হিপ জয়েন্টের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হবে। এভাবে তার বাম পা কেটে দীর্ঘ ৩ মাস সমরিতা হাসপাতালে রেখে বাবা বাবলুর রহমান জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর বাড়িতে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ২০১৫ সালে বিষয়খালী এসএম স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে।
এরপর খবর পেয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার তাকে একটি কৃতিম পায়ের ব্যবস্থা করে দেন। বর্তমানে সে কৃতিম পা এবং ক্রাচে ভর দিয়ে কোন রকম চলাফেরা করে। গত ২০১৬ সালে সে কালীগঞ্জ সরকারি মাহ্তাব উদ্দিন কলেজে বিএ ভর্তি হয় এবং সে বর্তমানে বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বর্তমানে তাদের সংসারে অভাব অনটনের কারনে সে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ইতিমধ্যে সে প্রতিবন্ধী কোটায় বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির জন্য আবেদনও করেছে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত ২০১৭ সালের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সে শারীরিক প্রতিবন্ধী কোটায় পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা প্রশিক্ষণার্থী পদে আবেদন করে কিন্তু সেখান থেকে তাকে জানানো হয় সে লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। এরপর সে সংসদ সদস্যকে জানালে সংসদ সদস্য তাকে জানায় তুমি লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে আমাকে জানালে আমি তোমার চাকরির বিষয়ে আন্তরিকতার সাথে চেষ্ঠা করবেন বলে আশ্বস্থ করেন। এরপর আগের মতোই ২০১৮ সালের একই বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবারও একই পদে প্রতিবন্ধী কোটয় ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি মাসে আরেকটা আবেদন করে। আবেদন করার পর তার মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষার দিন তারিখ আমাকে জানাবে বলে মোবাইলের মাধ্যমে জানতে পারি।
সে আরো জানায়, এই লিখিত পরীক্ষায় আমার চেয়ে অনেক ভালো ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েও তারা অকৃতকার্য হয়েছে। এ জন্য আমার মনে হয় এখানে টাকা ছাড়া চাকরি হবে না। এখানে যারা চাকুরী পাবে তাদের আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। এজন্য আমার মতো গরীব ঘরের পঙ্গু মেয়ের চাকরি কিভাবে সম্ভব? আমার ভর্বিষ্যতই বা কি হবে? সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে আমি যখন ইন্টারে পড়াশোনা করি তখন আমার বাবা ও মামারা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে দেখে। আমার ইচ্ছা না থাকলেও পরিবারের চাপে বিয়েতে রাজি হই এক শর্তে বিয়ের পরও আমকে পড়ার সুযোগ দিতে হবে। পাত্র পক্ষও আমাকে দেখে পছন্দ করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে যায় এবং বিয়ের ঠিক ২০ দিন আগে আমি এই দুর্ঘনার শিকার হই। কি দূর্ভাগ্য আমার, একটা পঙ্গু মেয়েকে তারা কেন বিয়ে করবে? সে বিয়ে ভেঙে যায়। বর্তমানে আমি খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করছি। আমি দুর্ঘটনার পর বাড়িতে আসলে আমার এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বর, এলাকাবাসী ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহায়তায় প্রতি মাসের প্রতিবন্ধী ভাতায় কোন রকম পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে আর কতোদিন এভাবে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকতে হবে?
সোনিয়ার মাতা ইসমত আরা জানান, সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা থাকে। তাই ভেবেছিলাম আমার পঙ্গু মেয়ে সরকারি চাকরি পাবে। এজন্য ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২ টি সরকারি চাকরিতে আবেদন করেছে কিন্তু কিছুই হয়নি। প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধী কোটায় আবেদন করা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাইনি।
কয়েকজন প্রতিযোগির মধ্যে নিজে একমাত্র প্রতিবন্ধী থাকায় নিশ্চিত ছিলেন এ পদে সোনিয়াই নিয়োগ পাবেন। কিন্তু পরে দেখলাম সে ঐ পদে নিয়োগ পায়নি।
পরিবার আর পরিচিতজনের কাছে সবসময়ই ভালো সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানান। বিশেষ করে তার নিজের পরিবারের সহযোগিতা না পেলে মেয়ের চিকিৎসা করা সম্ভব হতো না। অপরিচিত মানুষদের কাছ থেকে অনাকাঙ্খিত আচরণ পেয়েছে সে।
সোনিয়ার বলেন, আমরা গরীব, আমার মেয়ে শত বাঁধাকে অতিক্রম করে পড়ালেখা করছে।
আমার স্বামী সামান্য একজন কৃষক বসতভিটা বাদে মেয়ের চিকিৎসার জন্য সবই বিক্রি করা হয়েছে। আমাদের সংসার চালানো আর সম্ভব হচ্ছে না। এর মাঝে সোনিয়া ও তার ছোট ভাই দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে মোস্তাফিজুরের পড়ালেখার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পরছে। তাই তিনি তার পঙ্গু মেয়ে সোনিয়ার জন্য প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের একান্ত সহায়তা কামনা করেন।