কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারীতে হারানো বাবা-মায়ের খোঁজে হন্যে হয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী রওফি। এবার সেই রওফিকে নিজের মেয়ে দাবি করে দারে দারে ঘুরছেন কুড়িগ্রামের রফিতন বেওয়া (৬৫)।
সম্প্রতি নাড়ির টানে জন্মভূমি বাংলাদেশে এসেছিলেন হারিয়ে যাওয়া বাবা-মা বা বংশধরদের খোঁজে। সপ্তাহ খানেক বিভিন্ন জায়গায় চষে বেড়িয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে শূন্য হাতে ফিরে যান সুইজারল্যান্ডে বর্তমানে পালিত বাবা-মায়ের কাছে।
তার ফিরে যাওয়ার তিনদিন পর শুক্রবার সকালে তাকে নিজের মেয়ে দাবি করে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন চত্বরে ঘুরছেন সন্তান হারানো মা রফিতন। তিনি রওফির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।
রফিতন বেওয়া জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের অর্জুন গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তার স্বামীর নাম ছাত্তার আলী। ২২ বছর পূর্বে স্বামী মারা যান। স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন তিনি। তার সংসারে দুটি মেয়ে এবং একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। বড় সন্তান শাহেরা ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় হারিয়ে যায়। এরপর অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফি আসার সময় তিনি ছোট মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করায় তার সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে ফেসবুকে ঘটনা জানাজানি হলে প্রতিবেশীরা তাকে খবর দেন। শুক্রবার সকালে অনেক আশা নিয়ে ছেলে রফিকুলসহ তিনি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আসেন। কিন্তু সেখানে কেউ নেই।
রফিতন বেওয়া সাংবাদিকদের দেখে বলেন, ‘মোর বেটি কই? এক নজর তাক মুই দেখিম। তোমরা একনা ব্যবস্থা করি দেও।’
তবে রওফির দাবি- প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়ার সময় তার নাম ছিল খোদেজা। হারিয়ে যাওয়ার পর চিলমারী ছিন্নমুকুলে (বেসরকারি সাহায্য সংস্থ্যা) তার আশ্রয় মেলে। এখানে চার বছর থাকবার পর ১৯৭৮ সালের দিকে সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি তাকে দত্তক নিয়ে চলে যায়। এরপর থেকে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে বেড়ে ওঠেন তিনি।
রফিতন বেওয়া ও রফিকুলের কথার সঙ্গে সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফার কথার অনেক অমিল পাওয়া যায়। রওফা শ্যামবর্ণের হলেও রফিতন ও তার স্বামী ছিলেন অনেক ফর্সা। রওফি সাড়ে ৩ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার কথা বললেও রফিতন বেওয়ার মেয়ে শাহেরা হারিয়ে যায় ৭/৮ বছর বয়সে। দুজনের নামের মধ্যেও রয়েছে গরমিল। এছাড়াও ১৯৭৪ সালে তারা ছিলেন পার্শ্ববর্তী দলদলিয়া ইউনিয়নের অর্জুন গ্রামে।
দু’পক্ষের বর্ণনার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকলেও এক হারিয়ে যাওয়া কন্যার আঁকুতি আর মেয়ের জন্য মায়ের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরে বেড়ানো এলাকায় এখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
রফিতন বেওয়ার ছেলে থেথরাই বাজারে ঝালবুটের দোকানদার রফিকুল জানান, হারিয়ে যাওয়া শাহেরা ছিল সবার বড় বোন। সে কয়েক মাস স্কুলেও পড়েছিল। তার বাবা ছাত্তার আলী ছিলেন ধবধবে ফর্সা লোক। তার মাও ফর্সা। তারা প্রথমে দলদলিয়ার অর্জুন গ্রামে থাকলেও তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে সেই বাড়ি বিলীন হয়ে যায়। এর ছয় বছর পরে (২০১৩সালে) তারা থেথরাই শেখের খামার গ্রামে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেন। এখন মাকে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন তারা।
এ ব্যাপারে থেথরাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল জলিল শেখ বলেন, আমরা এলাকাবাসী রফিতনের হারিয়ে যাওয়া মেয়ের ঘটনার কথা সবাই জানি। এর আগেও চট্টগ্রামে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের খোঁজে গিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে সুজারল্যান্ডের অধিবাসী রওফার সঙ্গে রফিতনের মেয়ের অনেক মিল পাওয়া যায়। বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনে উভয়ের ডিএনএ টেস্ট করে দেখা দরকার। তাহলে বিধবা রফিতন মনে একটু শান্তি পাবেন।
জানা যায়, রওফি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় পড়াশোনা শেষ করে সেখানকার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জিইয়াস মরিনোকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ৫ বছরের ইলিয়াস নামের একটি পুত্রসন্তান রয়েছে।
তার সফরসঙ্গি ও অন্যান্য লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে সাড়ে ৩ বছর বয়সি খোদেজাকে উলিপুর উপজেলার থেতরাই বাজারে কাঁদতে দেখে পার্শ্ববর্তী চিলমারী উপজেলায় অবস্থিত বেসরকারি শিশু সংগঠন টেরেডেস হোমস এর একটি নোঙ্গরখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিল সে। এরপর সুইজারল্যান্ডের রওফি পরিবার তাকে দত্তক নেয়। ছোট্ট বেলার স্মৃতি একটি সাদাকালো ছবি নিয়ে সে নতুন বাবা-মায়ের সাথে পাড়ি দেয় জেনেভা শহরে। সেখানেই সন্তান হিসেবে পরিচতি লাভ করেন। পড়াশুনা শেষ করে জেনেভার সাইকেল ডেলা গোলেহে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে ২০০১ সাল থেকে কাজ করছেন। মা-বাবা হারানোর সময়ের স্মৃতি হিসেবে তার কোন কিছু মনে নেই। তবে তিনি জানান এতটুকু মনে রয়েছে আমি তখন অন্য কোন শহরে চলে এসেছি। এতদিন পরে আমি আমার নিজের জন্মভূমিতে এসেছি শুধুমাত্র আমার প্রকৃত মা-বাবা’র খোঁজে। কিন্তু আমি তাদের নাম-ঠিকানা কিছুই জানিনা। আমার কাছে শুধু আমার নিজের একটি ছোটবেলার সাদাকালো ছবিই আছে। শেষ বয়সে এসে যদি আমার মা-বাবা এবং বংশধরদের খুঁজে পাই। আমার থেকে বড় খুশি আর কেউ হবে না।
রওফি বলেন, এতটুকু মনে আছে আমি তখন অন্য কোনো শহরে চলে এসেছি। এতদিন পর আমি আমার নিজের জন্মভূমিতে এসেছি, শুধুমাত্র প্রকৃত মা-বাবার খোঁজে। কিন্তু আমি তাদের নাম-ঠিকানা কিছুই জানি না। আমার কাছে শুধু আমার নিজের একটি ছোটবেলার সাদাকালো ছবিই আছে। শেষ বয়সে এসে যদি আমার মা-বাবা এবং বংশধরদের খুঁজে পাই; আমার থেকে বড় খুশি আর কেউ হবে না।