Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ধ্বংসের পথে ঔপন্যাসিক ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বাড়ি  

শরিফুল ইসলাম, নড়াইল প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ০৩:২৯ PM
আপডেট: ১৭ জানুয়ারী ২০১৯, ০৩:২৯ PM

bdmorning Image Preview


'এপার বাংলার ও ওপার বাংলার' প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের পৈত্রিক বাড়িটি এখন ধ্বংসের পথে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় এ বাড়িটির সামান্য অংশ সংস্কার করা হলেও মূল বাড়িটির কোন সংস্কার বা মেরামত করা হয় নি। অবহেলা আর অনাদরে নিভৃত গ্রাম ইত্নায় পড়ে রয়েছে এ বিখ্যাত লেখকের পৈত্রিক বাড়ি।

ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯১১ সালের ৬ জুন  তাঁর  পিতা সত্যরঞ্জন গুপ্তের কর্মস্থল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান কলকাতায় হলেও তাঁর পৈত্রিক নিবাস নড়াইলের লোহাগড়ার উপজেলার ইত্না গ্রামে। চরম অবহেলায় নিমজ্জিত প্রখ্যাত এই বাঙ্গালি সাহিত্যিকের পৈত্রিক বাড়িটি এখনও অরক্ষিত। ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকু হারিয়ে যেতে বসেছে। 

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্ত চাকরিজীবী পিতার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান কালেই গাইবান্ধা হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে তিনি পড়াশুনা করেন। অবশেষে ১৯৩০ সালে তিনি কোন নগর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তিনি আই. এস. সি পাস করে ডাক্তারি পড়ার জন্যে কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে (বর্তমানে আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ) ভর্তি হন।

ডাক্তারি পাস করে বেশ কিছুদিন তিনি চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হন। অতঃপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর ডাক্তার হিসেবে যোগ দেন। চাকরি জীবনের বাধ্যবাধকতা তাঁর কাছে বিরক্তিকর মনে হওয়ায় তিনি এ চাকরি ত্যাগ করে কলকাতায় ব্যক্তিগতভাবে আবার ডাক্তারী শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতায় বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন।

নীহাররঞ্জন গুপ্তের সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়ে ছিল সুদূর শৈশবেই। ষোল বছর বয়সেই তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস 'রাজকুমারী' পত্রিকায় ছাপা হয়। ডাক্তার নীহাররঞ্জন গুপ্ত পেশায় চিকিৎসক হলেও মানব মানবীর হৃদয়ের ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক দ্বন্ধ-সংঘাতের একজন সুচারু রূপকার ছিলেন। রহস্য উপন্যাস লেখায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কেবলমাত্র রহস্য উপন্যাস নয়, তাঁর সামাজিক উপন্যাস গুলি সুখপাঠ্য যা-পাঠককুলের হৃদয় আকৃষ্ট করে।

তাঁর লিখিত উপন্যাসের সংখ্যা দুইশতেরও অধিক। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস গুলির মধ্যে ‘মঙ্গলসূত্র’, ‘উর্বশী সন্ধ্যা’, ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘অমৃত পাত্রখানি’, ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’, ‘মধুমতি থেকে ভাগীরতী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘অহল্যাঘুম’, ‘ঝড়’, ‘সেই মরু প্রান্তে’, ‘অপারেশন’, ‘ধূসর গোধূলী’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘কা লোভ্রমর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘ঘুম নেই’, ‘পদাবলী কীর্তন’, ‘লালু ভুলু’, ‘কলঙ্ককথা’, ‘হাসপাতাল’, ‘কজললতা’, ‘অস্থি ভাগীরথী তীরে’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘সূর্য তপস্যা’, ‘মায়ামৃগ’, ‘ময়ূর মহল’, ‘বাদশা’, ‘রত্রি নিশীথে’, ‘কনকপ্রদীপ’, ‘মেঘকালো’, ‘কাগজের ফুল’, ‘নিরালাপ্রহর’, ‘রাতের গাড়ী’, ‘কন্যাকেশবতী’, ‘নীলতারা’, ‘নূপুর’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মধুমিতা’, ‘মুখোশ’, ‘রাতের রজনী গন্ধা’ ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র উল্যেখযোগ্য।
নীহার রঞ্জনের চল্লিশের অধিক উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘লালুভুলু’, ‘হাসপাতাল’, ‘মেঘ কালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘নূপুর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বাদশা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মায়ামৃগ’, ‘কাজললতা’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি।

ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্তের লিখিত বহু উপন্যাস অবলম্বনে  চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্র জগৎকে তিনি সু-সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘লালুভুলু’ পাঁচটি ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বাংলাদেশেও চিত্রায়িত হয় এবং দর্শক কুলের প্রশংসা অর্জন করে। নীহার রঞ্জনের অনেক উপন্যাস থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস উল্কা দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটারের দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে।

চিকিৎসক হিসেবে অতি কর্ম চঞ্চল জীবনযাপনের মধ্যেও নীহার রঞ্জন রেখে গেছেন অসংখ্য সাহিত্যধর্মী সৃষ্টি, যা আপন সত্তায় ভাস্কর হয়ে থাকবে। নীহার রঞ্জন গুপ্ত ১৯৮৬ সালের ২০ জানুয়ারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

এই গুণী মানুষটির পৈত্রিক বাড়িটি এখনই রক্ষা না করলে অচিরেই কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এলাকাবাসী দাবী জানিয়ে বলেন, বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেও তাঁরা আমাদের কবি। তাঁদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্যভাবে পালিত হচ্ছে। অথচ এই গুণী ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এতটা সমুজ্জল থেকেও আমরা তাকে ভুলতে বসেছি। আমাদের প্রজন্ম জানেই না নীহার রঞ্জন গুপ্তকে এবং তিনি কি ছিলেন। তাই অবিলম্বে তাঁর পৈত্রিক বাড়িটি রক্ষা করে অন্তত পক্ষে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় সরকারিভাবে পালন করা হোক।

নড়াইলের প্রবীণ সাংবাদিক কে এম আকরামুজ্জামান মিলু বলেন, এ দেশে গুনীদের কদর নেই। বর্তমান প্রজন্ম জানে না ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্ত কে ছিলেন বা কোথায় তার বাড়ি। আমরা চাই এই গুনী লেখকের জন্ম ও মৃত্যুদিন যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করা হোক।

চিত্রকর  এস এম আলী আজগার রাজা বলেন, প্রখ্যাত এই ঔপন্যাসিকের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন না করলে আমরা অকৃতজ্ঞ থেকে যাব।

ইতনা ইউপির চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান টগর বলেন, ডা. নীহার রঞ্জন গুপ্ত নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার অহংকার। তাঁর স্মরণে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। তিনি দ্রুত এ লেখকের পৈত্রিক বাড়িটি সংস্কার করে সংক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুকুল কুমার মৈত্র বলেন, অতি দ্রুত বাড়িটি সংরক্ষণ করে সংস্কার কাজ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী সরকারিভাবে পালন করার জন্য উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।

 

 

Bootstrap Image Preview