আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার দেশের ৬৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ৬৭ জন নারী প্রার্থী, যা অতীতের সব জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী যা ৫ কোটি ১৬ লাখের বেশি। অথচ আওয়ামী লীগ থেকে ২০ জন এবং বিএনপি থেকে ১৪ জন নারী প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন। অন্যান্য দলগুলোতেও নারী প্রার্থীর সংখ্যা কম।
নারী প্রার্থী কম হওয়ার কারণ হিসেবে কী ভাবছেন নারীরা?
এ ব্যাপরে বিভিন্ন পেশার নারীদের মতামত তুলে ধরা হলো-
'কোন প্রার্থীকে ভোট দেয়া হবে সেটাও একজন নারীকে ঠিক করে দেয় তার পরিবার' এই বিষয়টি উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, 'প্রতিশ্রুতির উপর ভর করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সেখানে ৩০০ আসনে ৬৮ জন নারী প্রার্থী থাকাটা তেমন অবাকের বিষয় না। দলের বদল হচ্ছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতিগুলো নড়ে-চড়েও বসছেনা। নারীর ক্ষমতায়ণ নিয়ে বিভিন্ন দলের করা প্রতিশ্রুতিগুলো ইশতেহারেই আটকা রয়ে গেছে। তার উপরে নানান প্রতিবন্ধকতাতো রয়েছেই। সব থেকে দুঃখজনক হলো, একজন নারী কাকে ভোট দিবেন, কাকে দিবেন না সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের নিজের থাকেনা। বাবা কিংবা স্বামীর হস্তক্ষেপে তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে ভোট দিয়ে থাকেন। মূলকথা হলো, নারীকে মানুষ হিসবে ভাবতে পারার চর্চাটা পরিবার থেকে আগে শুরু করতে হবে তাতে যদি কিছুটা উন্নতি হয়।'
নীনা গোস্বামি (আইনজীবী) বলেন, 'আমি যদি মূল বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে চাই তাহলে এক কথায় নারীর সামাজিক প্রেক্ষাপটটায় মূলত কারণ। তাছাড়া নারীরা সঠিক আইন না জানার কারণেও অনেক দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। রাজনীতিতে রয়েছে টিকে থাকার লড়াই। সে লড়াইয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য নানান ধাপ পার হতে হয়। বাংলাদেশের নারীদের উচিত বেসিক আইনের চর্চা করা। তাহলেই সে নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে।'
ঢাকা মেট্রোপলিটনের গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকি বলেন, 'রাজনীতিতে নারীদের পদচারণার ক্ষেত্রে প্রথম বাঁধাটায় আসলে আসে পরিবার থেকে। ধরে নিলাম সে বাঁধা অতিক্রম করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেখানে যেটা হয় তা হলো প্রত্যেকটি দলের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ। তারপরেও ধরে নিলাম, সেখানে এই ৬৮ জন প্রার্থী নিজের অবস্থান জাহির করেছেন। এমনকি এটাও ধরেই নিলাম ৬৮ জন প্রার্থী নারীর ক্ষমতায়নকে বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাদের মধ্যে ঠিক কতোজন ভোটের লড়ায়ে জিতে যাবেন? তাছড়া একজন নারীর আর্থিক স্বচ্ছলতার কোথাও ভাবতে হবে। নির্বাচনী প্রচারনার জন্য সেটি কতোটা স্বচ্ছল।
হলিক্রস কলেজের প্রভাষক হামিদা রওশন আরা বলেন, 'আমরা যতই চিন্তা করি না কেন আমরা উন্নয়নের স্রোতে নারী পুরুষ উভয়েই সমান স্রোতে এগিয়ে যাচ্ছি, বিষয়টা কিন্তু বাস্তবে এখনও ততটা নয়। এর বিভিন্ন কারণ আছে তার মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক কারনগুলোতো আছেই। তবে এসবের বাইরেও নতুন আর একটা দিক নিয়ে মনে হয় আমাদের ভাববার সময় হয়েছে যেটা মূলত সামাজিক চিন্তাভাবনারই একটি প্রকাশক; মিডিয়ার ভূমিকা। আমাদের মিডিয়া এখনও প্রস্তুত নয় নারীকে শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি ভাবতে এবং ভাবাতে। এ সমাজ এখনও নারীকে মানুষ ভাবতে পারেনা ,যার কারণে একজন নারী প্রতিনিধির মধ্যেও আমরা বিভিন্ন সময় নারীসুলভ গুনাবলী, মাতৃত্বসুলভ আচরন খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করি। এর কারনে যোগ্য নেতৃত্বের মূল বিষয়গুলো একটু নড়বড়ে হয়ে পরে। বলিষ্ঠতা, ন্যায়পরয়নতা, বিচক্ষণতা, দায়িত্বশীলতার মতো গুনগুলোকে বাদ দিয়ে সে কার কন্যা, স্ত্রী, বোন; কতটা স্নেহশীল, মমতাময়ী এইগুনগুলো তার ওপর আরোপ করি দলগতভাবে এবং যোগাযোগের মাধ্যমেও। যা কিনা ভোটারদের দ্বিধায় ফেলতে ভীষনভাবে কাজ করে। আপনি আপনার সম্পদ কি একজন মমতাময়ীর হাতে দিতে চাইবেন নাকি একজন বিচক্ষণ, দায়িত্বশীল প্রতিনিধির হাতে রাখতে চাইবেন? কথা সেখানেই। আমাদের ভাষাগত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব আমাদের চিন্তাজগতকে চালিত করছে যার কারনে বিপ্লব যদি নারী নেতৃত্বের জায়গায় ঘটাতে হয় তবে নারী - পুরুষ নির্বিশেষে সকলে মিলে প্রকাশনা, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, সামাজিক যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যমে এ ববিপ্লবে অংশ নিতে হবে। নারীর জন্য সহনশীল মনোভাব নিয়ে নারী পুরুষ উভয়কেই তার জন্য "লেভেল প্লেইং ফিল্ড " তৈরি করে দিতে হবে রাজনীতির মাঠে। সংরক্ষিত আসন কখনোই পুরোমাত্রায় তা করতে পারবেনা।'
বাংলা ট্রিবিউনের ডেপুটি নিউজ এডিটর ফাতেমা আবেদিন নাজলা বলেন, '৩০০ আসনে ৬৮ জন নারীকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা বলেই মনে হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা নারী হওয়ায় এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের একটু গভীরে ভাবতে হবে, দেশে বাল্য বিয়ে রোধ হয়েছে কী? কত শতাংশ শিক্ষিত/ তৃণমূল পর্যায়ের নারী রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে বা করছেন? দখলদারিত্বের রাজনীতির যে সংস্কৃতি আমরা বয়ে চলেছি সেখানে নারীদের পেশিশক্তি দেখানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। আজ পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোতে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে নারীদের দেখেনি আমরা। তাই নারীদের নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা যতটা মসৃণ ভেবে প্রশ্ন তুলছি, ততটাই কঠিন প্রেক্ষাপট তৈরি করাটা। পারিবারিক রাজনীতির ইতিহাসেও কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে নারীদের দেখছি না। কয়জন রাজনীতিক পিতা উত্তরাধিকারী হিসেবে মেয়েকে প্রস্তুত করছেন? মোট কথা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থাই এই সংখ্যা কমের কারণ।'
ফ্রিল্যানস গবেষক এবং সামাজিক উদ্যোক্তা নাতাশা কবির বলেন, 'নারী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ার মতো করেই রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ণ বাড়ছে খুবই ধীর গতিতে। অতীতের রেকর্ড ভেঙ্গে প্রার্থী সংখ্যা ৬৮ হলেও যদি সার্বিকভাবে বিবেচনা করি তাহলে সেটি চোখে পড়ার মতোও না। আর তার জন্য একজন নারীর প্রথম বাধাটি আসে তার পরিবার থেকে। একজন নারী কোন জায়গার ভোটার হবে সেখানেও থাকে তার পরিবারের হস্তক্ষেপ, যেমনটা হয়েছে আমার সাথেও। দ্বিতীয়ত আমি মনে করি, আমরা দঃ এশিয়ানরা রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব সূচনার দাবীদার হলেও যেসব নারীরা ইতিমধ্যে রাজনীতিতে প্রবেশ করে আছেন এবং সফল তাদের অনেকেই নিজ সত্তায় নয়, বরঞ্চ পারিবারিক সূত্রে (সেটি হোক বাবা কিংবা বৈবাহিক) ধরেই এসেছেন। এটা মানতে হবে তাদের মাঝে অনেকেই যোগ্যতার ছাপ রেখেছেন এবং এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আর ছোট করে দেখার উপায় নেই। আর সর্বশেষ যেটা বলতে চাই পরীক্ষিত নারী নেত্রী ছাড়া অন্যদের দিয়ে নিরীক্ষা করতে আগ্রহী নয় কেউ। নারী নেতৃত্ব আনুপাতিক হারে বাড়লেও ক্ষমতায়ন এবং রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া এবং মতিয়া চৌধুরীর মত ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব এবং যদি স্থানীয় প্রশাসনও সেলিনা হায়াত আইভীর কথা ধরি ,পারিবারিক পরিচয় ছাড়া আসা যতটা হিরো আলমের সহজ ততোটায় নারীদের জন্য কঠিন। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন তার একটি বড় প্রমাণ। পরিচয় ধরে যারা আসে এটা যতটা না নারী তারচেয়ে বেশী সহানুভূতি এবং দলীয় কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ধরা হয়, হোক না গৃহবধূ বা রাজনীতি বিমুখ। আর আমাদের রাজনীতি এমনই আপনাকে পরিপক্ব করে তুলতে সহায়ক। এখন ভাবতে হবে পরিবার ছাড়া কোন নারীরা রাজনীতিতে সফল।'
ব্র্যাক পোগ্রাম অফিসার মাহমুদা খা বলেন, 'সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী কম হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে একজন নারী পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিটা জায়গাতেই হয়রানির শিকার হয় বিভিন্ন ভাবে যার ফলে অনেকেই রাজনীতিতে আসতে চাইলেও পশ্চাৎপট অবস্থায় তারা বিরাজ করেন নয়ছয় ভেবে। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলে নারীর অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। এই নগন্যতার আরেকটি বড় কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। যত দিন না নারীর প্রতি পুরুষের এই পশ্চাৎপট অবস্থান পরিবর্তন হবে ততদিন নারীর রাজনৈতিক দেউলিয়াপণা থাকবেই। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার নিমিত্তে ২০২০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করার জন্য ২০০৯ সালে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ যুক্ত করা হয়, যাতে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যত হয়। রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় স্তরে বা কমিটিতে নারীর এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। আমি নিজেও একটা সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে অনেক বৈষম্যর শিকার হয়েছি, এমনকি এও দেখেছি সেখানকার কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যোগ্য নারী কর্মী থাকার পরেও তাদের ভাইটাল পোষ্টে নিতে খুবই হীনমন্যতায় ভোগতেন আমাদের পুরুষ কর্মীরা। আমার মতে তাদের ধারণা একজন নারীকে তারা ভাইটাল পোষ্টে কিংবা তার নেতৃত্বে সংগঠন পরিচালনা করার দায়িত্ব দিবে এ চিন্তা করেই তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়।'
ঢাকা ৩ আসনের বাসিন্দা গৃহিণী আছমা বেগম বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। মায়েদের সন্তানের দেখাশোনার বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। রংপুরের ভোটার আমি। স্বামী আর দেবর বাড়ি গিয়েছেন ভোট দেবেন বলে। ছেলেমেয়েদের জন্য আমি রয়ে গেছি ঢাকাতে। আমি মনে করি, একজন নারী যখন তার নিজ সত্তার কাছে স্বাধীন হবে, তখনই নারীর ক্ষমতায়ণ সম্ভব।'
প্রসঙ্গত, এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন ১১৮ জন নারী। এর মধ্যে বিএনপির ৪৩, আওয়ামী লীগের ১৯, স্বতন্ত্র ১৮, জাতীয় পার্টির ১১ ও অন্যান্য দলের ২৭ জন। তাঁদের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের বাছাইয়ে বাদ পড়েন বিএনপির খালেদা জিয়াসহ ১০, জাতীয় পার্টির তিন এবং স্বতন্ত্র ১২ সহ মোট ২৬ জন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নির্বাচন কমিশনে আপিলে প্রার্থীতা ফিরে পান।
পরে টিকে থাকাদের অনেকেই তাঁদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ৩০০ আসনের মোট এক হাজার ৮৪৮ প্রার্থীর মধ্যে ৬৭ আসনে ৬৮ জন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে ৬৮ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন; এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের হয়ে ‘নৌকা’ প্রতীকে ২০ জন, বিএনপির হয়ে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে ১৪ জন, জাতীয় পার্টির ‘লাঙল’ নিয়ে ৫ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৬ জন ভোট করছেন।
এছাড়া ন্যাশনাল পিপল্স পার্টির (এনপিপি) ৪ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) ৩ জন, জাকের পার্টির ৩ জন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ২ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএলের ২ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির ২ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন ভোটের মাঠে।
এছাড়া জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপা, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ, গণফ্রন্ট, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন করে নারী প্রার্থী নির্বাচন করছেন।