আজ ২১ ডিসেম্বর শুক্রবার মরমি কবি ও বাউল সাধক হাসন রাজার জন্মদিন।
১৮৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে লক্ষ্মণশ্রী গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মাতা মোসাম্মৎ হুরমত জান বিবি। হুরমত বিবি ছিলেন আলী রাজার খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা।
পরবর্তীতে হাসন রাজার পিতা আলী রাজা তাকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হাসন রাজা ছিলেন তার দ্বিতীয় পুত্র। হাসনের পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তারা হিন্দু ছিলেন। অতঃপর তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে এসে থিতু হন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
পনেরো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হলে সংসার ও জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। যৌবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন ও ভোগবিলাসী, কিন্তু পরিণত বয়সে সব বিষয়-সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ জীবন যাপন করেন। তাঁরই উদ্যোগে সুনামগঞ্জ হাসন এম ই স্কুল, অনেক ধর্ম-প্রতিষ্ঠান ও আখড়া স্থাপিত হয়। বিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্রের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করতেন। কিন্তু হাসন রাজার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও হাসন রাজা ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় এক হাজার আধ্যাত্মিক গান রচনা করেন।
স্থানীয় বাউল-ফকিরেরা সেসব গান গেয়ে তাঁকে পরিচিত করে তোলে। হাসন রাজা ছিলেন একজন ঐশীপ্রেমী এবং সেই প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই তিনি গান রচনা করতেন। তাঁর গানে প্রেম ও বৈরাগ্যময় আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গানগুলি যেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একটি মিলন ক্ষেত্র। তিনি গানের ভণিতায় নিজেকে ‘পাগলা হাসন রাজা’, ‘উদাসী’, ‘দেওয়ানা’, ‘বাউলা’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কৈশোর ও যৌবনে শ্রীকৃষ্ণের নানাবিধ লীলায় অভিনয়ও করেছেন।
হাছন উদাস (১৯০৭), শৌখিন বাহার, হাছন বাহার ইত্যাদি গ্রন্থে তাঁর গানগুলি সংকলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, হাসনের অনেক কবিতা ও গানে পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধন পাওয়া যায়। হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারীতে অভিষিক্ত হন। হাসন বেশ সুপুরুষ দর্শন ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবী ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। তখন সিলেটে ঘরে ঘরে আরবী ও ফার্সির প্রবল চর্চা চলত।
হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌকাবিহারে চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন প্রচুর গান রচনা করেছেন।
হাসন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাসন রাজা ও তার পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন।
এছাড়াও, সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাসন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগাপ্লুত করে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। তাঁর এই কবর তিনি মৃত্যুর পূর্বেই নিজে প্রস্তুত করেছিলেন।