সাদা রঙের একটি অ্যাম্বাসেডরের পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছেন সুচিত্রা। তীব্র দাবদাহ, পুরো কলকাতা পুড়ছে।
অ্যাম্বাসেডর পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে একটু এগোতেই ফুটপাতে একজনকে দেখে সোজা হয়ে সিটে বসলেন তিনি।
ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করতে বলে নিজেই নেমে এগিয়ে গেলেন সেই মানুষটির দিকে। এই কাঠফাটা গরমে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছেন স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক! বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার!
হাতজোড় করে প্রণাম করতে করতে সুচিত্রা বললেন- আমাকে চিনতে পারছেন ঋত্বিক দা! আমি সুচিত্রা। গত বছর শান্তিনিকেতনে দেখা হল।
চমশার ওপর দিকে তাকিয়ে ভালো করে মুখটা দেখলেন ঋত্বিক। তারপর বললেন- ও হ্যাঁ, তুমি সুচিত্রা রায় তো! টালিগঞ্জ বাড়ি। অন্নদাশঙ্কর রায় তোমার কী রকম জ্যাঠা হন না? ঠিক বলছি তো?
সুচিত্রা আপ্লুত হলেন। কী সৌভাগ্য! এত বড় মানুষটা সব মনে রেখেছে!
সুচিত্রা কলকাতার শিল্পপ্রেমী বনেদি পরিবারের মেয়ে। জন্মের পর থেকেই কলকাতার সব মহিরুহদের সামনে দেখে বড় হয়েছেন। ইদানীং প্রায় বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন। ঋত্বিক ঘটকের মূল্য তিনি বোঝেন। তাকে মনে মনে গুরু মানেন সুচিত্রা।
ঋত্বিক ঘটকের পরনে ছিল ধুলোমলিন পায়জামা পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, একমাথা এলোমেলো চুল। মুখে খোঁচখোঁচা দাড়ি। সেই মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
এই জবুথবু অবস্থায়ও তার চোখের আগুন এক ফোঁটা কমেনি। ঋত্বিক ঘটক মানেই এক আগুনের নাম। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’- এ ছবিগুলোয়ই যে আগুনের ছাপ স্পষ্ট। সুচিত্রা খেয়াল করলেন ঋত্বিকের পেছনে একটি ব্যানারে বড় করে লেখা, ‘বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য দান করুন’।
ব্যানারের পাশেই বড় একটা বাক্স। সেখানে রাস্তার মানুষ টাকা ফেলে যাচ্ছেন। বাক্সের পাশে লম্বা একটি টুল। তার ওপর গিটার হাতে এক বিদেশি তরুণ বসে আছেন। গায়ের রং তামাটে। হিপিদের মতো লম্বা চুল।
চোখে সানগ্লাস, আর মুখভর্তি লালচে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। পরনে ঢোলা বেলবটম পেন্ট ও রঙিন হাওয়াই শার্ট। মাথায় একটি সাদা রঙের সোলার হ্যাট। গিটার আর মাউথ অর্গান বাজিয়ে নাকি গলায় তরুণটি গাইছে-
Comes senators congressmen
Please heed the call
Don't stand in the doorway
Don't block up the hall.
গানটি সুচিত্রার পরিচিত। কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলানের গান। ঋত্বিক ঘটক তরুণকে দেখিয়ে বললেন- ও হল স্টিভ টার্নার। গায়ক ও সাংবাদিক। সপ্তাহখানেক হল আমেরিকা থেকে এসেছে। স্টিভের সঙ্গে কবি অ্যালান গিনসবার্গও কলকাতায় এসেছেন।
স্টিভকে হ্যালো বলে কৌতূহলী সুচিত্রা জানতে চাইলেন- গিনসবার্গ কোথায়?
ঋত্বিক বললেন- অ্যালান আজ সকালে শক্তির সঙ্গে বারাসাত শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন।
শক্তি? মানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়?
হ্যাঁ, গতকাল অবদি টাকা-পয়সা যা জমেছিল, তা দিয়ে ওরা ওষুধ আর খাবার কিনে নিয়ে গেল।
ঋত্বিক সুচিত্রাকে বললেন- এলেই যখন বাংলাদেশের জন্য দুটো টাকা দিয়ে যাও। বলেই তিনি হাত বাড়ালেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে সুচিত্রা বললেন- ছি দাদা, এমন করে বলছেন কেন? আমি কী দূরের কেউ? বলেই কড়কড়ে কয়েকটি একশ’ টাকার নোট দিলেন ঋত্বিকের হাতে।
হঠাৎ করে ঋত্বিক সুচিত্রাকে প্রশ্ন করলেন- সুচিত্রা, তুমি একসঙ্গে কত লাশ দেখেছ? একশ? দুশ? তিনশ? চারশ? পাঁচশ? ছয়শ? সাতশ? আটশ? নয়শ?
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত এক ঘোরলাগা কষ্ট নিয়ে সুচিত্রা আবার অ্যাম্বাসেডরে চড়ে বসলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। সুচিত্রা ভাবছেন, যে ভুখণ্ডের অসহায় মানুষের জন্য এই পাগলাটে মানুষটা তীব্র দাবদাহে পুড়েছেন, কেঁদেছেন, চিৎকার করেছেন, সেই ভুখণ্ডে তো ঋত্বিক দা আর কখনও ফিরে যাবেন না জেনেও........।
ঋত্বিক ঘটকরা পরিবারসহ সাতচল্লিশ সালেই ওপারে চলে গেছেন। তবুও... এত বড় ফিল্ম ডিরেক্টর, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, যে ঋত্বিক ঘটককে জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেই মানুষটি কেমন নাওয়া, খাওয়া ভুলে জলন্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার শরণার্থীদের জন্য ভিক্ষা করেছতারনে। সুত্রঃ ইন্টারনেট