Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

চট্টগ্রামের শুঁটকির খ্যাতি দেশ-বিদেশে, পুরোদমে শুরু হয়েছে উৎপাদন

বশির আলমামুন, চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০১:৫৬ PM
আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০১:৫৬ PM

bdmorning Image Preview


বন্দর নগরী চট্টগ্রামে পুরোদমে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের তীর ছাড়াও কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম এসব শুঁটকি পল্লী। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষা বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট, ফিসারী ঘাট, চাক্তাই, রাজাখালী, মইজ্যারটেক ও জুলধায় গড়ে উঠেছে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ।

এসব এলাকার শতাধিক স্পটে গড়ে তোলা শুটকি আড়তে প্রতিদিন সূর্যের তাপে শুকানো হচ্ছে সাগর থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে ছোট-বড় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ। নারীসহ প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন শুঁটকি উৎপাদন কাজে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে চট্টগ্রামের এসব শুঁটকি আড়তে মাছের গুঁড়াসহ ১৫ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত অক্টোবর মাঝামাঝি সময়ে শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম শুরু হলেও সাগরে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মাছের অভাবে গত মাসে শুঁটকি উৎপাদন হয়নি। তবে শেষ দিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলেও সাগরে লঘুচাপজনিত কারণে চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টি হয়। বর্ষণ থেমে যাওয়ার পর নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে শুটকি উৎপাদন শুরু হয়।

বর্তমানে শহরের বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট, ফিসারী ঘাট, চাক্তাই, রাজাখালী, মইজ্যারটেক ও জুলধা, কক্সবাজারের নাজিরারটেক মহেশখালী, সোনাদীয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, বাশঁখালীসহ উপকূলীয় বিভিন্ন শুঁটকি আড়তে পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। কর্ণফুলীর তীরে ও সাগরের বালিয়াড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার উপর কাঁচা মাছ পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি।

বর্তমানে সূর্যের তাপে ৩/৪ দিনের মধ্যেই কাঁচা মাছ শুকিয়ে গিয়ে শুঁটকিতে পরিণত হচ্ছে। এরপর উৎপাদিত শুঁটকিগুলো বস্তাবন্দী করে ট্রাকে করে পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্নস্থানে। এমনকি বিদেশেও যাচ্ছে চট্টগ্রামের শুঁটকি।
জানাযায় দেশ ব্যাপী রয়েছে চট্টগ্রামের শুটকির সুনাম। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের শুঁটকির খ্যাতি। প্রতিদিনই এখানে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করার কাজে চলে। এতে কমংস্থান হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের।

 

বৃহস্পতিবার (৬ ডিসেম্বর) বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর শুঁটকি আড়তে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, শুটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কর্মচাঞ্চল্য। যার যার মত ব্যস্ত সবাই। যেন দম ফেলার ফুসরত নেই কারো। সেখানেই একটি আড়তে নারী শ্রমিক হিসাবে নিয়োজিত আছেন ছখিনা বেগম(৩৮)।

তিনি জানান, সূর্য ওঠার পর সেই ভোর থেকেই কর্মব্যস্ততা শুরু হয়। আর সূর্য ডোবা পর্যন্ত এভাবে চলে।

পাশের আড়তে রাবেয়া খাতুন বলেন, সারাদিন কাজ শেষে মজুরি পাব ২০০ টাকা। আর তা দিয়েই চলে সংসার।
শুধু ছখিনা-রাবেয়া নয়, তাদের মত দুই হাজারের বেশি নারীসহ প্রায় পাচঁ হাজার শ্রমিকের আয়-রোজগারের উৎস চট্টগ্রামের এই শুঁটকি আড়তগুলো।

আছাদগঞ্জ শুঁটকি আড়তদার সমিতির সভাপতি শফিউল আলম বলেন, এখন শুঁটকির ভরা মৌসুম। কিন্তু দস্যুতার কারণে এবার সাগরে মাছ শিকার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে শুঁটকির প্রধান মোকাম কক্সবাজারের সোনাদিয়া, নাজিরার চেক, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, সুন্দরবন ও রাঙ্গাবালি এলাকা থেকে শুঁটকি কম আসছে।

তিনি আরো বলেন, গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম শুরু হলেও সাগরে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মাছের অভাবে গত মাসে শুঁটকি উৎপাদন হয়নি। তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও অনুকূল আবহাওয়ায় সাগরে পুরোদমে মাছ ধরা শুরু হলে নভেম্বর মাসের শুরু থেকে ধীরে ধীরে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়।

তিনি জানান, এ বছরও রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, পোপা, টেকচাঁদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা ও নাইল্যা মাছসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে এসব আড়তে।

শুটকি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্ষাকালে টানা বৃষ্টির সময় ছাড়া বছরের ৭/৮ মাস শুঁটকি উৎপাদন চলে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ মেট্রিক টন করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে এখানে। যেহেতু সাগরে প্রচুর ‘পাঁচকাড়া’ মাছ ধরা পড়ছে, যেগুলো থেকে শুটকি তৈরি হয়।

চট্টগ্রাম মৎস্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ জাতের ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু চট্টগ্রামে নয়, এখানে উৎপাদিত শুঁটকি ঢাকা, রাজশাহী, নাটোরসহ সারাদেশের মানুষের চাহিদা মেঠানো হচ্ছে। এমনকি এখানে উৎপাদিত শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশ চট্টগ্রামে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

শুঁটকি তৈরিতে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহারের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এ প্রবণতা দিন দিন কমে আসছে। নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে কয়েকটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ সভা করে যাচ্ছি।

বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া, মহেষখালী, সোনাদিয়া, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকার গভীর সমুদ্র থেকে জেলেদের সংগ্রহ করা মাছ কর্ণফুলীর তীরে আনা হয়। সস্তা শ্রমিক ও নৌপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই দিন দিন প্রসার ঘটছে চট্টগ্রামের শুঁটকি পল্লিটির। চলে জমজমাট বেচাকেনাও। বাশঁ দিয়ে মাচাং বানানো এসব শুটকি পল্লীতে কাঁচা মাছগুলো সারি সারি মাচানে তুলে রোদে শুকানো হয়।

এখানে অনেক জাতের শুঁটকি তৈরি করা হয়। এখানকার লইট্টা শুঁটকির চাহিদা দেশজুড়ে। এর মধ্যে ছুরি, লইট্ট্যা, ফাইশ্যা, হাঙর, বাইল্যা, পোপা, চাঁদা বাইল্যা, টিক্কা, ফ্লাইং, কোরাল ফিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকি উল্লেখযোগ্য। শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি লাক্ষা ও রূপচাঁদা। 

নভেম্বর-ডিসেম্বর সাধারণত শুঁটকির ভরা মৌসুম। এ সময় দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জসহ বিভিন্ন আড়তে শুঁটকির ব্যাপক যোগান আসে। কিন্তু চলতি মৌসুমে এসব আড়তে শুঁটকি সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শুঁটকির বাজারে। ফলে ভোক্তাদের বেশি দামে শুঁটকি কিনতে হচ্ছে। 

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে শুঁটকির চাহিদা (প্রতি বছর) রয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার ৭৫০ টন। এরমধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২২ হাজার টন। বাকি ৩৩ হাজার টন মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্থান থেকে আমদানি করা হয়। যা মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ।

বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে উদ্বেগের বিষয়, পোকা মাকড় থেকে রক্ষা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এসব শুঁটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। যা স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর খুবই ক্ষতিকর।

Bootstrap Image Preview