Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর এ্যাড. মোঃ আজিজুর রহমান

মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
প্রকাশিত: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৫:৫৯ PM
আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৫:৫৯ PM

bdmorning Image Preview
ছবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, এ্যাড. মোঃ আজিজুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমেদ


বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা তথা উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূখ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানে অন্যতম বিপ্লবী মুখটি ছিল এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান (এমএনএ)। যিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে সহপাঠী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সহচর।

ইতিহাসের সোপানে নির্মিত অবিকৃত সত্য হলো, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় (বর্তমান দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা) সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশর ভূ-খণ্ড এবং লাল সবুজের পতাকা পাবার জন্যে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারই অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান, এম এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য) ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টর এবং ৬ নং সেক্টর (অর্ধেক এর) ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার, ফ্রিডম ফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াঁজো অফিসার এবং একইসাথে পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক 'ক জোনে’র প্রশাসনিক কর্মকর্তা।

স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান এবং সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। (দিনাজপুর ইনস্টিটিউটে সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। তথ্য: ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খণ্ড নং ৫। পৃষ্ঠা নং: ২৭৬।

আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, খণ্ড-১৫)।   

প্রবাসী সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে, মুজিব নগর সরকার এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭ নং সেক্টর এবং ৬ নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্যে ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার উক্ত পদে দায়িত্ব  প্রদান করে। (তথ্যসূত্র: ৩০ আগস্ট ১৯৭১ সালে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিব নগর সরকারের জারিকৃত গোপন পরিপত্র নং: ০০০৯জি/২)।

ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার, ফ্রিডম ফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভূক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। তিনি ৭ নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হককে নিয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু ৭১’ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মেজর নাজমুল হক শিলিগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে, তিনি উক্ত সেক্টরের দ্বিতীয় সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামানকে নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের গৌরবময় রক্তলাল পতাকা উড়িয়ে দেন।

প্রসঙ্গত, একইসাথে তিনি পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক 'ক জোনের' প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। (সূত্র: মুক্তিযোদ্ধা তালিকার লাল বই, স্বরণীয় যারা, বরণীয় যারা। পষ্ঠা নং-৯ এবং মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, ভলিউম নং ১৪)।
 
জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিব নগর সরকারের জারিকৃত সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী উক্ত সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধনস্ত সকলের জন্যে তাঁর নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেবার এখতিয়ার তাঁর ছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাঁর সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল। উক্ত সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদ মর্যাদায় মোট দশজন নিযুক্ত ছিলেন এবং সকলেই ছিলেন এম এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য)।

মোহম্মদ আজিজুর রহমান ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ লা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম আলেকজান নেসা। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সাথে যুক্ত তাঁর বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুলজীবনে ১৯৩৭ সালে শেরে এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষে ভারত পাকিস্তান ভাগ হলে তিনিও সেখানের ছাত্রত্ব শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিজ ভূমিতে ফিরে এসে দেশগড়ার কাজে হাত দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে দেশে ফিরেই কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ক্রমান্বয়ে পূর্বপাকিস্তান শোষণ করবার পাকিস্তানী শাসকদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে শুরু করেন এবং কাল বিলম্ব না করে তাঁর শিক্ষা, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন এ অঞ্চলের মানুষের ভেতর ’বাঙালি বোধটিকে জাগ্রত করতে।

১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতি দবিরুল ইসলাম দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেফতার হলে, মোঃ আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই উজ্জ্বল নেতার রাজনৈতিক পদযাত্রায় দেখা যায়, তিনি ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলা মুসলিম ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক। এরপর ১৯৪৪ সালে ডিস্টিংশনসসহ (সকল বিষয়ে ৮৫% নম্বর) তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।  

১৯৫০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজুপর বার এসোসিয়েশনে যোগদান করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করেন। পবরর্তীতে তিনি দিনাজপুর বার কাউন্সিলের দু’বার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রট সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে ঘোড়াঘাট থেকে তেতুঁলিয়া প্রায় দু’শ কিলোমিটারে মতো এই বিস্তৃত অঞ্চলে অক্লান্তভাবে সাংগঠনিক পরিশ্রম করেন এবং একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তথ্য: ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খণ্ড-৫।

তাঁর আগুনঝড়া বক্তৃতায় মানুষের চোখ খুলতে শুরু করে। এরই পাশাপাশি জনতার মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগাতে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ১৯৫৫ সালে সাপ্তাহিক আওয়াজ নামে সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি সম্পাদক এবং মালিক হিসেবে এই পত্রিকার মাধ্যমে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। (তথ্য: ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খণ্ড-৫। পৃষ্ঠা নং: ২৫৫ এবং ৫৮২)।

১৯৫৭ সালের ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনে তিনি দিনাজপুরের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন এবং সেই সম্মেলনে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি এবং জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে একান্ত আলোচনায় মিলিত হন।

বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি ১৯৬০-  জুন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণার প্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের জেল জুলুমের ভয়ে রাজপথ থেকে যখন বেশীরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ালেন, এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান মাথায় গ্রেফতারের হুলিয়া নিয়েও জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতা-কর্মী নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকর সভাপতি) হিসেবে রুখে দাঁড়ান আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্যে একজন বিপ্লবীর।

দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এ্যাডভোকেট মোহম্মদ আজিজুর রহমান বৃহত্তর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে তেতুঁলিয়া পর্যন্ত কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বাইসাইকেলে চড়ে, কখনো বাস আর কখনো গরুর গাড়িতে করে হাতে টিনের বানানো চোঙ্গা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুুটলেন, পথে পথে ডাকলেন বাঙালিকে। তাঁর আইন পেশা এক রকম লাটে উঠলো। নিজের জমির ফসল আর কখনো প্রয়োজনে জমি বিক্রির অর্থে দল আর সংসার চালাতে লাগলেন। সাধারণ মানুষের কাছে সাদাকাগজে বানানো অতিক্ষুদ্র আকারের চাঁদার বইসহ কিছু তরুণদের নিয়ে হাত পাতলেন দলের জন্যে চার আনা করে চাঁদা চাইতে।

তাঁর অকুতোভয় প্রল কর্মকাণ্ডে বৃহত্তর দিনাজপুরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুও ভোঁতা হয়ে গেল। তিনি উপেক্ষা করলেন সকল বাধা। দিনাজপুরে আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলো এবং তিনি তৎকালীন ঠাকুরগাঁ মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করলেও তাঁর সিংহহৃদয় দেশপ্রেমের কারনে অসাধারণ বাগ্মী মোঃ আজিজুর রহমান বৃহত্তর দিনাজপুর আওয়ামী লীগ রাজনীতির অপরিহার্য এবং শীর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি নির্বাচিত সভাপতি হিসেব ভূমিকা পালন করেন ১৯৬৭ সাল হতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট মোহম্মদ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৭০-১৯৭১ এর কমিটিতে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক (পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী )।

বাংলাদশের ভূ-খণ্ড এবং লাল সবুজের একটি পতাকা পাবার জন্যে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম তারই অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান, এম এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য) নির্বাচিত হলেন ১৯৭০ সালে।
বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা বার কাউন্সিলের সভাপতি এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে দল এবং দলের বাইরে জনপ্রিয়তার প্রবল স্রোতই তাঁকে ১৯৬৮ এবং ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকায় দেখা যায়, তিনি ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে  এম এন এ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য,  ঠাকুরগাঁ, বালিয়াডাঙ্গি, রানিশংকৈল এবং হরিপুর থানা) নির্বাচিত হন।  এরপর ১৯৭১ সালের ১ লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত করে দিলে প্রতিবাদী জনতা নেমে আসে রাজপথে। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি দিনাজপুর আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হিসেবে সকল দলের নেতাদের নিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতাকে দৃপ্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন। ছুটে বেড়াতে থাকেন দিনাজপুর শহর থেকে ঠাকুরগাঁ মহকুমা শহর এবং তাঁর নেতৃত্বে জেলার সকল এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য) এবং এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) বৃন্দকে নিয়ে প্রতিটা থানার স্থানীয় নেতাদের সংগঠিত করে তোলেন।

যুদ্ধের শেষধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁ শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিত সিং আরোরার সাথে মিলিত হন। তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্র বহিনীর অগ্রগামী দলের সাথে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতা উত্তর সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এম এন এ) এর মর্যাদার বদলে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লি অব বাংলাদেশ) হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন।  

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সকল ১৬৭ জন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এম এন এ) এবং ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) মিলিয়ে সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে এমসিএ ( কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যসেমব্লী অব বাংলাদেশ) হিসেবে মর্যাদালাভ করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যতম কান্ডারি এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের সূর্যসন্তান, সর্বস্বত্যাগী অকুতোভয় এই জননেতা মোঃ আজিজুর রহমান ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ঘাসিপাড়াস্থ ভাড়াবাড়িতে নিভৃতে ইন্তেকাল করেন। দিনাজপুর শহরে সোনাপীর গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত।

মহান মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের এমন সব সত্য তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, দিনাজপুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে জঘন্যমত মিথ্যাচার চলছে। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর, দিনাজপুর জেলায় একটি স্বার্থান্বেসী রাজনৈতিক পরিবার বই ছাপিয়ে, মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে এই বিপ্লবী জননেতার নাম মুছে দেবার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত। অথচ ৭ নং সেক্টর এবং ৬ নং সেক্টর (অর্ধেকের) ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার, ফ্রিডম ফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াঁজো অফিসার এবং পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক ’ক জোনে’র প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মোঃ আজিজুর রহমানের পরিবারের কাছে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো আসল দলিল আছে। সেসব দলিলের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনগত ও প্রশাসনিক প্রতিবাদ হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে ইতিহাস সত্য। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রতিষ্ঠা পাবে এবং অকুতোভয় এই সংগ্রামী বীর এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমানের প্রতি জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো যাবে।

লেখক: এ্যাড. মোঃ আজিজুর রহমানের ছেলে, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Bootstrap Image Preview