ফারুক হাসান।।
ঘটনাগুলো অতীত কিন্তু স্মৃতি সব সময় বর্তমান। প্রতিদিন ঘুমাতে গেলে আর ঘুম থেকে ওঠলে চোখের সামনে ভাসে সহস্র স্মৃতি। আমরা এখন স্মৃতির ফেরিওয়ালা। হায়রে দু:খভরা স্মৃতি! হায়রে আনন্দভরা আনন্দ! হায়রে মুক্তিকামী জীবন!
সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আন্দোলন সংগ্রামের দিনগুলোতে আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা। এটা হবারই কথা, তাই না? ছাত্রজীবনে আন্দোলন সংগ্রাম পড়াশুনারই অংশ সবাই বলে। তাহলে দু:খ কোথায়? মনের কষ্ট আর পত্রপত্রিকায় ছাপানো বেদনাদায়ক দৃশ্যগুলো যখনই দেখি তখনই অশ্রুন্সিক্ত হই। এখন আর আমি কাঁদতে পারি না, কিন্তু ভুলতেও পারি না এই বাংলাদেশে কিভাবে এতকিছু ঘটে গেল আমাদের সাথে। শান্তনা পাই এটুকু ভেবে আমরা অন্তত কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। এই দেশের জন্যে আমরা কিছু একটা করতে পেরেছি।
বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বৃহৎ তিনটি ছাত্র আন্দোলনের স্বাক্ষী আমি নিজেই। লাখ লাখ শিক্ষার্থীও দেখেছে এই আন্দোলনগুলো। এই বাংলাদেশও যুগ যুগ স্বাক্ষী থাকবে এই আন্দোলগুলোর। ২০১৫ সালে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষায় ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন, ২০১৮ সালের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ এবং ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এই ৩টি আন্দোলন এই বাংলাদেশকে নতুন করে ভাবালো। এই তিনটি আন্দোলনে সরকার সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে। প্রতিরোধে সকল পদ্ধতি এ্যাপ্লাই করেও পরাজিত হয়েছে সরকার। ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের উদ্যোক্তা আরিফ চৌধুরী শুভ ভাইয়ের বিভিন্ন লেখায় এখনো আমরা জানতে পারি কতটা অমানবিক আচরণ সেদিন সরকার শিক্ষার্থীদের সাথে করেছে। আমরাও দেখেছি সেই আন্দোলনে আসলে কি ঘটেছে। এই সরকারের আমলে সেদিনই শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিল তারা চাইলে যেকোন যৌক্তিক দাবি নিয়ে তারা বিজয় চিনিয়ে আনতে পারে। ভ্যাট আন্দোলন ছিল এই সরকারের আমলে প্রথম শিক্ষার্থীদের বিজয়। তাই এখনো মানুষ ছাত্র সমাজকে নিয়ে ভরসা পায়। ছাত্র সমাজ এই ভরসা কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে দেখিয়ে দিল। ভবিষ্যতেও দেখিয়ে দিবে আশা করি।
৬২ এর শিক্ষা আন্দোলনের পরে সংঘঠিত শিক্ষা আন্দোলনগুলোর মধ্যে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ইতিহাসে বৃহৎ ছাত্র আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনের পরে এই উপমহাদেশে এই আন্দোলগুলো গবেষকদের চিন্তার হিসেবকে ঠিক ১৮০ ডিগ্রি উল্টে দিল। উচ্চ শিক্ষায় যে ভ্যাট হতে পারে না এবং শিক্ষা যে কোন পণ্য না, তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিল সেদিন।তারা মাঠে এলো, ভাবালো এবং জয় নিয়ে ফিরলো।
একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে ৫৬% কোটা কতটা যৌক্তিক এবং মূলস্রোতে সেটি কতটা পরিপন্থি, তা দেখিয়ে দিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। কোটার সংস্কারের মাধ্যমে ১০ শতাংশ কোটা রাখার দাবি সর্বমহলে আড়োলিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধ্যয়ন কেন্দ্রের জরিপে দেখানো হয়েছে দেশের ৯৪ শতাংশ মানুষই কোটার সংস্কার চেয়েছে। সুতরাং এই সংস্কারে কোন প্রশ্ন কারোই থাকারই কথা না। সরকার প্রধানও যখন সংসদে হাক-ডাক দিয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলেন, তখন সস্তির বাতাস বইলো আন্দোলনকারীদের মধ্যে। কিন্তু তারপর থেকেই শুরু দু;খের ইতিহাস। মামলা হামলা আর আন্দোলনকারীদের মেরে নদীতে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনাসহ কি না ঘটেনি, এই অান্দোলনকারীদের সাথে। তবুও আমরা ভয় পাইনি, পাবো কেন? আমরাতো স্বাধীন দেশেরই নাগরিক। বঙ্গবন্ধু আমাদের ভয় পেতে বলে যাননি। বলেছেন যেখানে অন্যায়, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। আমরা তাই করেছি। তবে এই আন্দোলন নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, যত শিক্ষার্থী এই আন্দোলন করেছে, তাদের সবাই কি সরকারি চাকুরি পাবে বা করবে? তবুও তারা আন্দোলন করেছে কেন? শুধু নিজেদের বিবেকের কারণে এই আন্দোলনে তারা রাস্তায় নেমেছে। এই বিবেকগুলো যতদিন এই বাংলায় থাকবে ততদিন এই দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে। ততদিন রক্ত ঝরলেও তারা সফল হবে। বাংলাদেশ সফল হবেই।
যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, ঘুষ, চাকুরি বাণিজ্য, প্রশ্ন ফাঁস, পরীক্ষা না দিয়েও উত্তীর্ণ হওয়া যায়, সে সমাজে আন্দোলনের বিকল্প আসলেই কিছু নাই। হচ্ছেও তাই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে রাস্তায়। তারাও মার খেয়েছে হাঁতুড়ি পেটুয়াদের হাতে। তবুও তারা বুকে ধারণ করেছে ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি ঘুরে দাঁড়াও তবে তুমিই বাংলাদেশ’। তারা দেখিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্যে একটি জাতি অপেক্ষা করতেছে সুযোগ আর সময়ের অপেক্ষায়। সময় মতো সেটি করবেই। বাংলাদেশের অমূলক পরিবর্তন আসবেই।
এই আন্দোলনগুলো অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাধারণকে সাহস এবং শক্তি দিয়েছে বদ্ধ শিকড় থেকে মুক্তি আশায়। সেদিন আন্দোলনকারীদের হাঁতুড়ি পেটা করলো যে ছাত্রলীগ ভাইটি, আজ সে ভাইটি কি নিজেকে অন্তত একবার জিজ্ঞেস করবেন আপনার সরকারতো আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে। তাহলে আপনি কি ভুল করেননি আমাদের গায়ে হাত দিয়ে? নাকি আমাদের দাবি মেনে নিয়ে আপনার সরকার ভুল করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভুল মানুষের পিছনে ভুল মানুষরাই দৌঁড়ে ব্যক্তি স্বার্থে। ঠিক ভুল মানুষরা কখনো দেশের কাণ্ডারী হতে পারে না। ভুল মানুষেরা যুগে যুগে পরাজিত হয় এবং পরাজয় তাদের হতেই হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যুগ্ম-আহবায়ক, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
বি.দ্র.: এই লেখার সকল দায়ভার লেখকের নিজের।