Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

ব্যর্থ শিউলি এখন সফল উদ্যোক্তা

হৃদয় দেবনাথ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০১৮, ১১:১৮ AM
আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:০০ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


প্রতিদিন সূর্য ওঠে আর অস্ত যায় পশ্চিমে। এভাবেই শিউলি আক্তারের স্বপ্ন মিলায় রাতের অন্ধকারে। চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। হতাশাই যেন নিত্য সঙ্গি তার। দিনের আলো, অন্ধকার, সব জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করেন একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে। তবুও সফল হওয়ার বিশ্বাস হারাননি তিনি। নিজের প্রতি অধিক মনোবল, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রমই ব্যর্থ শিউলিকে সফল উদ্যোক্তা হতে সহযোগিতা করেছে। জেলা থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায়ে শিউলি হয়েছেন সেরা উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা পরিচালক শিউলি আক্তারের সাথে কথা বলে আই বিশেষ ফিচার প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি হৃদয় দেবনাথ।

শিউলি আক্তার। সিলেট বিভাগের একজন সফল উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবেই এখন সবার কাছে পরিচিত। শ্রীমঙ্গল শহরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। বাবা-মা ও ৫ ভাইসহ ৭ সদস্যের পরিবারে শিউলি সবার বড়। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অসুস্থ বাবা মায়ের চিকিৎসার ব্যয় আর স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া ভাইদের পড়াশুনার খরচ যোগাতে টিউশনি করে উপার্জন করা ছাড়া তার সামনে বিকল্প কোন পথ ছিল না।একমাত্র নিজের অদম্য চেষ্টায় দিনরাত টিউশনি করে শিউলি স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। চাকুরির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত শিউলি চাকরি নামক সোনার হরিণটাকে ধরতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শিউলি কি তাহলে হেরে যাবে?

ভাবতে ভাবতে শিউলি একদিন তার কম্পিউটার প্রশিক্ষক সন্তুশ সরকারের পরামর্শে যোগাযোগ করেন শ্রীমঙ্গল পৌরসভায়। সেখানে তিনি পৌর ডিজিটাল সেন্টারে উদোক্তা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। গ্রামের প্রান্তিক জনগণের নিকট ই-কমার্স সেবা পৌঁছে দেওয়াই ছিল তার মূল কাজ। আগে নিজে শিখেছেন এবং পরে অন্যকে অবহিত করতেন কিভাবে ই-কমার্সের সেবা নিতে হয়। এ কাজের জন্য প্রথম কয়েক মাস সামান্য উপার্জন হলেও ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। এভাবেই দিন-দিন বদলে যেতে থাকে শিউলির ভাগ্য। প্রধানমন্ত্রীর এটু আই প্রোগ্রাম বদলে দেয় শিউলির ভাগ্যের চাকা। সাত সদস্যের পরিবারে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় বদলে যেতে থাকে জীবন। এভাবে ডিজিটাল সেন্টারের সফল উদ্যোক্তা হয়ে যান তিনি।

শিউলির মাসিক আয় কত? এমন প্রশ্নে জবাবে মৃদু হাসি দিয়ে শিউলি বলেন, সর্বনিম্ন ৩৫০০০ হাজার টাকা। তবে কোন কোন মাসে আরো অনেক বেশিও উপার্জন হয়।

শিউলি আরো বলেন, আমার কাজের জন্য ২০১৫ ও ২০১৮ সালে মৌলভীবাজার জেলায় এবং ২০১৭ সালে সিলেট বিভাগে সেরা উদ্যোক্তা নির্বাচিত হয়েছি আমি।তাছাড়া ২০১৮ দেশব্যাপী ই-কমার্স সম্প্রসারণের লক্ষে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটু আই প্রোগ্রামে "এক শপ" একটি ইন্টিগ্রেটেড ই-কমার্স প্লাটফর্ম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সারা বাংলাদেশের মধ্যে আমি তৃতীয় স্থান অর্জন করি। শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তার সম্মাননা আমাকে কাজের প্রতি আরো বেশি আগ্রহ যুগিয়েছে। আমি এখন এটু.আই উদ্যোগের ই-কমার্স মার্কেট প্লেস একশপ কার্যক্রমের একজন সদস্য। আজ আমি খুবই সুখী।বাবা- মায়ের মুখে আমি হাসি ফোটাতে পেরেছি।

শিউলি আক্তারের মা সেলিনা বেগম বিডিমর্নিংকে বলেন, ও শুধু আমার মেয়েই নয়, আমাদের পরিবারের রত্ন। এত বড় পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সে একাই বহন করেছে। পরিবারের জন্য শিউলির ত্যাগ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। অভাবের সংসারে মেয়েটা হাসি ফোটালো সবার মুখে। মেয়ের ত্যাগের আর কষ্টের কথা বলতে গিয়ে বার কয়েক অশ্রু মুছলেন তিনি।

শিউলির বাবা সুবল মিয়া বিডিমর্নিংকে বলেন, শিউলি মেয়ে হয়ে একজন ছেলের চেয়েও বেশি করলো এই পরিবারের জন্য। আমার বয়স হয়েছে। আমি রোগাশোকা মানুষ। কাজকর্ম করতে পারি না। মেয়েটা না থাকলে কি যে হতো আমাদের।

চাকরি নামক সোনার হরিনের পিছনে ঘুরে ঘুরে যারা সময় নষ্ট করে তাদের জন্য শিউলি আক্তার পরামর্শ সময় নষ্ট না করে কম্পিউটারের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হোন, আয় করুন। সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করুন। ই-কমার্স সেক্টরই একমাত্র প্লাটফর্ম, যেখানে ইচ্ছে করলেই যে কোনো চাকরি থেকেও পাঁচগুন অর্থ আয় করা সম্ভব।

পৌর ডিজিটাল সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি ডিজিটাল সেন্টারটি চালু করার পর থেকে ই-মেইল, ইন্টারনেট, জন্ম-নিবন্ধন ফরম পূরণ, ফটোকপি, লেমেনেটিং, ছবি তোলাসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

শ্রীমঙ্গল পৌরসভার অফিস সহকারি অসীম দাস বিডিমর্নিংকে জানান, আমাদের পৌরসভার আওয়ায় নারীদের বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিউলি আক্তারও এক সময় আমাদের এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারপর থেকেই শিউলি আক্তার শ্রীমঙ্গল পৌর ডিজিটাল সেন্টারে উদ্দ্যেক্তা পরিচালকা হিসেবে কাজ শুরু করে। এরপর শিউলি আক্তারের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মহসিন মিয়া মধু বিডিমর্নিংকে বলেন, তথ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার ডিজিটাল সেন্টার চালু করেছে। এই ডিজিটাল সেন্টার থেকে অনেক মানুষ সুবিধা ভোগ করছেন। এলাকার মানুষজন বেশিরভাগ প্রবাসী হওয়ায় আগে তারা এই ধরণের কাজে ভোগান্তি পোহাতো। সেই সাথে পাঁচগুণ টাকাও খরচ হতো। অনেক সময়ও নষ্ট হতো। মানুষকে এইসব কাজে সহযোগিতা করেছে শিউলি আক্তার। সে তিন বার জেলা ও বিভাগে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।

ডিজিটাল সেন্টার চালু হওয়ার ফলে শুধু শিউলি আক্তারই নন, মৌলভীবাজার জেলার শত বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম।

Bootstrap Image Preview