Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

রবীন্দ্রনাথকে নিজের মত করে স্বকীয় উপায়ে উপস্থাপন করার অধিকার সকলেরই রয়েছে: পার্বতী গুপ্ত

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:০৮ PM
আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:২০ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


ছোট বেলায় মায়ের শাড়ির কাপড় দিয়ে মঞ্চের পর্দা বানিয়ে শুরু হয় তার নৃত্য ও নাট্য চর্চা। পরবর্তীতে সান্নিধ্যে আসেন ড. মঞ্জুশ্রী চাকি সিরকরের। যোগ দেন ভারতের “ডান্সারস গিল্ড” নাট্যদলে। তিন বছর নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করার পর সংসার এবং জীবিকার খাতিরে মঞ্চ থেকে চলে যান পর্দার পেছনে। যদিও পর্দার পেছনে কাজ করা নিয়ে কোন আফসোস নেই তার বরং এই সৃষ্টিশীল ভূমিকায় থাকতে পারায় তার ভেতর তৈরি হয় অন্যরকম রোমাঞ্চ।

তার নাম পার্বতী গুপ্তা। ১৯৮৩ সালে, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে দলের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এখনও পালন করে যাচ্ছেন সেই গুরুভার তবে পাশে আর নেই মঞ্জুশ্রী চাকি। পাশাপাশি চালিয়ে নিচ্ছেন মৃত্তিকা নামের আরও একটি নৃত্যগোষ্ঠী।

গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধনী দিনে নাটক `তোমারই মাটির কন্যা’ পরিবেশন করতে এসেছিলেন দল নিয়ে। সেই সুযোগেই কফির কাপে বিডিমর্নিং এর সাথে হয়ে গেল জমপেশ আড্ডা।

আড্ডার একাংশ সাক্ষাৎকার হিসেবে প্রকাশ করা হল আজ। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিডিমর্নিং প্রতিনিধি নুসরাত জেরিন নিশু।

নুসরাত জেরিন নিশু: গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবের প্রথম দিন `তোমারই মাটির কন্যা’ মঞ্চায়িত করে কেমন সাড়া পেলেন?

পার্বতী গুপ্তা: অসাধারণ। প্রতিবারই আমরা বাংলাদেশে এত সুরুচির দর্শক পাই যে মন জুড়িয়ে যায়। দর্শক সারিতে বসা মানুষগুলো নাটকের এমন জায়গাতে করতালি দিচ্ছিলেন, যেগুলো নাটক সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কোনভাবেই বোঝার কথা নয়। যখন চণ্ডালিকা তার মায়ের কাছে ব্রাহ্মণকে এনে দেওয়ার জন্য আকুতি করছিল, সেই সময় দর্শককে মেয়েটির মনের চঞ্চলতা বোঝাতে পারা ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। কিন্তু ঠিক সেই সময় দর্শকের বিকট করতালি প্রমাণ করে দেয় যে নাটকের মাধ্যমে দর্শকের সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।

নুসরাত জেরিন নিশু: বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কেমন লাগছে। নতুন কোন পরিবর্তন অনুভব করেছেন?

পার্বতী গুপ্তা: আমাদের বাংলাদেশে আসা তো এবারই প্রথম নয়। এরআগেও আমরা অনেকবার এসেছি বাংলাদেশে। তবে এবারের উৎসবের পরিসর ছিল বিশাল। প্রতিবারই আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আগের চাইতে উত্তরণ হচ্ছে। আর মানুষের সংখ্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে, মঞ্চে নাট্যকর্মী, নাট্যজন, সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা যে প্রতিনিয়তই বাড়ছে তা আমি অনুভব করতে পারি।

নুসরাত জেরিন নিশু: দুই বাংলার ভেতর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পার্থক্যের জায়গাটা কোথায়?

পার্বতী গুপ্তা: পার্থক্য ঠিক কতোটা করা যায় জানি না। তবে এখানে শিল্পীদের অনেকটা স্রোতের বিপরীতে ছোটার মত অবস্থা। সংস্কৃতি চর্চার জন্য তাদের সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক নানা রকম লড়াই করতে হয় বলে তাদের ভেতর অন্য রকম একটা তাগাদা আছে। নানান দায়বদ্ধতা থাকে বলেই হয়তো শিল্পের বিকাশে এখানকার সংস্কৃতিকর্মীরা একেবারে মরিয়া হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক চাপ একটু কম হওয়ায় আর আর্থ-সামাজিক সহায়তা থাকার কারণে অনেক সহজেই আমরা শিল্পীরা মতপ্রকাশ এবং সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যেতে পারি। কলকাতা বলো আর ভারতবর্ষই বলো আমাদের ভাগে শিল্পের জন্য লড়াই এবং সংগ্রাম বরাবরই কম পড়েছে।

নুসরাত জেরিন নিশু: “ডান্সারস গিল্ড” এর পেছনের ইতিহাস জানতে চাই।

পার্বতী গুপ্তা: ডান্সারস গিল্ডের শুরুটা হয়েছিল ড. মঞ্জুশ্রী চাকিরহাত ধরে। তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার পাবনার মেয়ে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজ চোখে দেখেছিলেন দেশ বিভাগ।

তখন থেকেই দেশান্তরের তীক্ষ্ণ ব্যথা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সবকিছু ছেড়ে, নিজের শেকড় থেকে দূরে চলে আসার কষ্ট প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবেই নাচ বেঁছে নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে মেয়ে রঞ্জাবতি সিরকরের সাথে মিলে ময়ুরভঞ্জ ছৌ, কন্ডন, আংশিক ক্লাসিক্যাল, ভারতনাট্যম, কথাকলি, মনিপুরী, অডিসি, লোকনৃত্য, মার্শাল আর্ট, যোগমুদ্রা, নিত্য ব্যবহার্য অঙ্গভঙ্গির সমন্বয়ে “নবনৃত্য” নামের একটি নতুন নৃত্যধারা তৈরি করেছিলেন।

সেই নৃত্যধারা চর্চার জন্যেই পরবর্তীতে ডান্সারস গিল্ড তৈরি হয়। আমার কাছে এটি শুধু নাট্যদল নয় বরং একটি পরিবার। আমাদের নিজস্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ একাডেমি এবং স্টুডিও রয়েছে।

নুসরাত জেরিন নিশু: “নবনৃত্য” এবং অন্যান্য নৃত্যের ভেতর কাঠামোগত পার্থক্য কি?

পার্বতী গুপ্তা: মঞ্জুশ্রী দিদি সাহিত্য এবং নৃতত্ত্বের উপর বিস্তর পড়াশোনা করেছিলেন। এমনকি আমেরিকা থেকে পিএইচডিও করেছিলেন নৃতত্ত্বের উপর। সুতরাং, সাহিত্য এবং নৃতত্ত্ব, এই দুইয়ে মিলে তৈরি হয়েছে “নবনৃত্য”। মানুষ এবং তার জীবন প্রবাহ পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে নাচকে আবিষ্কার করার এই দর্শন অন্যান্য নৃত্যাঙ্গিকে নেই।

নবনৃত্যের মূল লক্ষ্য হল সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় বিভেদ ছাপিয়ে গিয়ে নাচকে সার্বভৌমিক এবং আন্তর্জাতিক চেতনা তৈরির কাজে প্রবাহিত করা।

অনেকেই মনে করে আমাদের নৃত্যধারায় পশ্চিমা সংস্কৃতির ব্যবহার আছে। কিন্তু সেটা ভুল। যেটা আছে সেটা হল দেশিয় বিলূপ্ত প্রায় নৃত্যমুদ্রাগুলো একত্রিত করে বিশ্বাঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা। যেমন ধরুন, ময়ুরভঞ্জ ছৌ। ছৌনৃত্যে দুই পায়ের সমান ব্যবহার হয় এবং লাফিয়ে নাচতে হয় বলে অনেকেই সেগুলোকে পশ্চিমা মনে করে। অথচ, প্রকৃতপক্ষে এই নাচগুলো ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য। তবে আমাদের মঞ্চ পরিকল্পনায় পশ্চিমা অনুপ্রেরণা রয়েছে। একই সময়ে মঞ্চের অনেকগুলো অংশকে একসাথে ব্যবহার করা হয় আমাদের নাটকে।

নুসরাত জেরিন নিশু: এখনতো অনেকেই নবনৃত্য এবং লোকনৃত্য চর্চা করছে!

পার্বতী গুপ্তা: লাফিয়ে নাচলেই সেটা নবনৃত্য হয়ে যায় না। অনেকেই জানে না যে আমরা মুদ্রা এবং কৌশলগুলোকে বিক্রিত করি না। যারা করার চেষ্টা করছে তা পুরোটাই একটা অক্ষম অনুকরণ। মাঝে মাঝে মনে হয় ভেঙাচ্ছে।

নবনৃত্য করতে লম্বা অনুশীলন দরকার। শুধু ইন্টারনেট থেকে দেখে দেখে নকল করলেই অথবা দুই-চারটা কর্মশালা করে এটা শেখাসম্ভব নয়।

অবশ্য নবনৃত্যের ধারা পরিপূর্ণভাবে বজায় রাখতে পেড়েছি এইকথা বড় মুখে না বলতে পারলেও এতটুকু বলতে পারি যে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সুধীজনেরা বলে, আমরা পারছি।

নুসরাত জেরিন নিশু: ডান্সারস গিল্ড এর ৯০ শতাংশ নাটক রবীন্দ্রনাথ এর অ্যাডাপ্টেসন। এর কারণ কি?

পার্বতী গুপ্তা: বাঙালির জীবন জুড়ে ছেয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ, এর থেকে আলাদা কি করে হই? আর বিশ্বাঙ্গিকে তুলে ধরবার জন্য বিশ্বকবির বিকল্প কেইবা হতে পারে? প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথকে আমরা নতুন করে চিনছি। সূর্য যেমন একেক বেলায় একেক রুপ ধারণ করে, ঠিক তেমনি। আমাদের বিশ্বাস, তার লেখার উপর এখনও অনেক কাজ করা বাকি রয়ে গিয়েছে।

আমি বেশ জোর দিয়েই একথা বলবো যে রবীন্দ্রনাথের লেখার উপর মঞ্জুশ্রী চাকির মত নৃত্যভাষ্য আর কেউ এখন অব্দি করেনি। তোমারি মাটির কন্যায়, গদ্যনাট্যের একটি অংশকে পটভূমি ধরে নিচু শ্রেণির সংগ্রাম দেখিয়ে গিয়েছেন তিনি। সেজন্যে ব্যবহার করেছেন অনেক কঠিন সংলাপ এবং ছৌ ও মার্শাল আর্টের মত কঠিন নৃত্যভঙ্গি।

এ জন্য বরাবরই সমালোচিত হয়েছি আমরা। প্রথমদিকে আমাদের কাজকে অরাবীন্দ্রিক এবং পশ্চিমা বলেও দাবি করেছেন অনেকে। কিন্তু আমরা ভেবেছি গল্প এবং নৃত্যশৈলীর প্রয়োজনে যদি আমাদের কিছু পরিবর্তন আনতে হয় তবে আমরা আনবো। যেমন ধরুন, রবীন্দ্রনাথের নাচে এখন যেভাবে পেঁচিয়ে শাড়ি পরার চল রয়েছে সেটা কিন্তু আগে ছিল না। শুরু করেছিলাম আমরাই প্রথম। সুতরাং, রবীন্দ্রনাথকে নিজের মত দেখেও স্বকীয় উপায়ে উপস্থাপন করা সম্ভব এবং সেই অধিকার সকলেরই রয়েছে।

নুসরাত জেরিন নিশু: আপনার কখনও মনে হয়েছে, “তোমারি মাটির কন্যা” নাটকে চণ্ডালিকার মেয়ে ‘প্রকৃতি’ চরিত্রটি সমাজে একটি নারী বিদ্বেষী ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারে?

পার্বতী গুপ্তা: করতে পারে বলতে কিছু নেই। পশ্চিমা সভ্যতা বল আর পূর্ব সভ্যতাই বল, নারী বিদ্বেষী চেতনা তো তৈরি হয়েই আছে। এটা থেকে উত্তরণের রাস্তাটা খুঁজে বের করতে হবে আর কি। প্রকৃতি যখন তার সংলাপে বলছে, “আমি শিকারির ভোগ্য বস্তু”, তাতেই উঠে আসছে গতানুগতিক সামাজিক অবস্থা। এটা লুকানোর কিছুই নেই।

নুসরাত জেরিন নিশু: ভারতে মঞ্চ নাটককে জীবিকা উপার্জনের একমাত্র পন্থা হিসেবে নেওয়া সম্ভব হয়েছে কি?

পার্বতী গুপ্তা: সেই অবস্থা ভারতবর্ষে নেই। দেখ, আমাদের দলের ১৫ জনের ভেতর আমি আর আলোক সম্পাতে যিনি আছেন তাকে বাদ দিয়ে বাকি যে ১৩ জন আছেন, তারা সকলেই নৃত্যশিল্পী। কাঁচা বাংলায় বলতে গেলে পেট চালানোর জন্য তাদের অন্য কাজ করতেই হয়। আমাদের দলের বেশির ভাগই শিক্ষকতা করছে বর্তমানে।

নুসরাত জেরিন নিশু: আমরা প্রায়ই দেখি বড় পর্দার শিল্পীদের মঞ্চে কাজ করার আগ্রহ নেই। আবার মঞ্চের শিল্পীরা বড় পর্দায় কাজ করতে চাইছে না। এই বিভেদ তৈরি হওয়ার কারণ কি?

পার্বতী গুপ্তা: যেকোন বড় পর্দার শিল্পী যে তুলনামূলক ভালো কাজ করছে, খবর নিলেই জানতে পারবেন তিনি আগে মঞ্চে কাজ করে এসেছেন। আসলে সকলের চাওয়া- পাওয়া এবং স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গাটা এক নয়। কারও কাছে শিল্প বেশী মূল্যবান এবং কারও কাছে অর্থ। এটাই স্বাভাবিক।

ধন্যবাদ জানিয়ে সাক্ষাৎকার শেষ করে বিদায় জানানোর এক পর্যায়ে পার্বতী গুপ্ত বললেন, “বাংলাদেশ আমার কাছে মামা বাড়ির মত। প্রতিবারই পেট ভরে খাই এবং দু’পক্ষের চোখের জলে বিদায় জানাই।“

ভালো থাকুক পার্বতী গুপ্ত এবং কাঁটাতারের ওপারের সকল আত্মীয়েরা।

Bootstrap Image Preview