Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ঢাকার রাস্তায় ‘ভাইরাল পোশাক’ কারা কিনছে?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৫:৩৪ PM
আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৬:২০ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কল্যাণে এখন সবকিছুই মানুষের কাছে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে রাতারাতি তারকা খ্যাতি লাভ করে আবার অনেকে এর কল্যাণে নিজের অর্জিত সম্মানও ক্ষুইয়ে বসেন। যা থেকেই হাল আমলে ভাইরাল কথাটির বেশি প্রচলন হয়েছে। তবে সেসব ঘটনা আবার খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় অন্য কোন ভাইরাল ঘটনার আগমনে। এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অংশে পরিণত হয়েছে। দেশে দিনে দিনে স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে ভাইরাল যেকোন কিছু খুব সহজেই তরুণ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর এসবের প্রভাব পড়ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবেনে।

যে সব ঘটনা, কথা বা গান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় দুদিন পর সেটা মানুষের মুখে মুখে চলে আসে। কখনও সেটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, কথাবার্তায় এমনকি পোশাক-আশাকে তার প্রভাব পড়তে থাকে। আর এসবে এগিয়ে থাকছে দেশের তরুণ-তরুণীরা।

এই যেমন ধরুন সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি নানা ধরণের অশ্লীল, অসঙ্গতিপূর্ণ ভিডিওবার্তা ছড়িয়ে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন সিফাত উল্লাহ ওরফে সেফুদা নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশি। নানা বিষয় নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে অল্প সময়ে 'তারকা' বনে যান অস্ট্রিয়া প্রবাসী সেফুদা। ভিডিও বার্তায় সেফুদার অনেক উক্তি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মাঝে গণহারে ছড়িয়ে পড়ে। সেফুদার এসব উক্তি লেখা অনেক পোশাক সে সময় বাজারে আসে। যা এখনও মাঝে মধ্যে ফুটপাতের খুচরা দোকানসহ অন্যান্য মাকের্টে পাওয়া যায়। তবে শুধু সেফুদা নয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া অনেক উক্তি এখন শোভা পাচ্ছে ফুটপাতে বিক্রি হওয়া টি-শার্টে। যা  জনপ্রিয়তা পাচ্ছে একটা নিদিষ্ট সংখ্যক ক্রেতাদের কাছে।

সম্প্রতি এমন চিত্র দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায়। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতেই ওভারব্রিজের মুখে দেখা গেল এমন বিভিন্ন ধরনের  লেখা গেঞ্জি। আগ্রহ নিয়ে বিক্রেতার কাছে বিডিমর্নিং এর এই প্রতিবেদক এমন সব  লেখা গেঞ্জি বিক্রির কারণ জানতে চাইলেন।

বিক্রেতা জানালেন, ফেসবুকে যে সব উক্তি ভাইরাল হয় সেগুলো তারা টি-শার্টে ব্যবহার করেন। যেসব উক্তি ভাইরাল হয় অনেক ক্রেতা তেমন সব উক্তি দিয়ে লেখা টি-শার্ট খোঁজ করেন। এই কারণে এমন গেঞ্জির চাহিদা বেশ থাকে।

তার কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ফেসবুকের শব্দ, বাক্য এখন পোশাক পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ছে। তরুণদের মাঝে এই পোশাক কেনার প্রবণতা বেশি বলে জানান এই বিক্রেতা। এই বিক্রেতার কাছে, সেফুদার কী হিংসে হয় লেখা টি-শার্টসহ নো গালর্ফেন্ড নো প্যারা, লেবেল বুইজ্জা কথা ক, আমি তো ভালা না, ভালা লইয়ায় থাইকো, একদিন তো মরেই যাবো, নাম বললে চাকরি থাকবে না এমন লেখা সব গেঞ্জি দেখা যায়।

সংবাদকর্মী পরিচয়ে দিলে এই বিক্রেতা এর আগেও বিক্রি  হওয়া টি-শার্টের বিষয়ে এই প্রতিবেদককের সাথে কথা বলেন। তার দেয়া তথ্যমতে, এক সময় আয় বুকে আয়, কিছু করো না হয় সরো, গুটিবাজ, পাগলু, গালর্ফেন্ড আছে, আমি বড় বিপদে আছি, বন্ধু চিনলি নারে লেখাসহ বিভিন্ন ধরনের লেখা গেঞ্জি বিক্রি করেছেন। যা অল্প সময়ে নতুন অন্য কোন লেখা গেঞ্জি আসার কারণে বাদ হয়ে গেছে।

বিক্রেতার কথায় জানা গেল স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলে থেকে শুরু করে এক শ্রেণির তরুণরা এই সব গেঞ্জি কিনছে। যারা অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণে চেষ্টা করে। বিক্রেতার সাথে সাথে বলতে বলতে এই প্রতিবেদকের সাথে দেখা হয় মিরপুরের একটি স্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়া ইব্রাহিমের সাথে।

হাতে বালা, গলায় লকেট আর কিছুটা লম্বা চুল মেহেদি দিয়ে রঙ করা ইব্রাহিম ‘নো গালর্ফেন্ড নো প্যারা গেঞ্জির’ দরদামে ব্যস্ত। দামে না মিললেও গেঞ্জিটা কেনার জন্য প্রবাল আগ্রহে একটা সময় সে গেঞ্জিটা কিনে নেয়।

গেঞ্জি কেনার পর এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় ইব্রাহিমের। ইব্রাহিম জানায়, তার স্কুলের বন্ধুরা অনেকেই ‘নো গালর্ফেন্ড, নো প্যারা’ গেঞ্জি কিনেছে। সেই কারণে তিনিও এই গেঞ্জি কিনেছে। রাস্তা দিয়ে চলাচল করলে কেমন লাগবে জানতে চাইলে হাঁসি দিয়ে চলে যায় সে।

ফুটপাতের ওই বিক্রেতার পাশে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে এই প্রতিবেদক দেখতে পান রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এমন লেখা টি-শার্টগুলো। কেউ কেউ হাঁটা থামিয়ে এক পলকে পড়েও নিচ্ছেন।

এদের একজন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা রেজাউল করিম। তিনি বিডিমর্নিংকে জানান, এমন ধরনের লেখা গেঞ্জি একটা ছেলের পারিবারিক পার্শ্ববর্তী, পরিবেশের চিত্র ফুটে ‍উঠে। অনেকে আবার না বুঝেই কিনছে। মূলত একটা শ্রেণির তরুণদের আকর্ষণ করেই এই গেঞ্জিগুলো তৈরি হয়। সবাই কিন্তু এগুলো কিনবে না। এবং বড় বড় মার্কটেও কিন্তু এগুলো বিক্রি হয় না। শুধুমাত্র ফুটপাতেই এমন লেখা গেঞ্জি বিক্রি হচ্ছে।

অর্থাৎ তার কথায় এটা স্পষ্ট একটা লেবেলের ক্রেতা ধরতে এমন চটকদার লেখা দিয়ে গেঞ্জি তৈরি। এর ক্রেতাও তারা যারা নিয়মিত স্যোশাল মিডিয়ায় নিজেদের ‘উদ্ভটভাবে উপস্থাপন’ করতে চায়। ফেসবুকের সেই সব বিষয়গুলোই তারা পোশাক ও দৈনন্দিন চলাফেরায় প্রয়োগ করতে চাই। যার সত্যতা মিললো এসব গেঞ্জি তৈরি ও পাইকারী বিক্রির মার্কেটে গিয়ে।

মিরপুরের ওই বিক্রেতার দেয়া তথ্যমতে বিডিমর্নিং এর এই প্রতিবেদক যান গুলিস্তানের ট্রেড সেন্টারে। এখান থেকেই পাইকারী বিক্রি হয় এমন লেখা গেঞ্জি। এই মার্কেটের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ দোকানেই এমন লেখা গেঞ্জি ঝুলিয়ে রাখা। আর এসবের বিক্রিও বেশ ভালো। এমন লেখা গেঞ্জি আছে কী না জানতে চাইতেই প্রতিটি দোকানী বিভিন্ন লেখা গেঞ্জি বের করে দেখান।

তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এমন লেখা  মূলত তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ভাইরাল হওয়া বিষয়গুলো থেকে বাছাই করে। এখানকার দোকানগুলোতে ঘুরে, ভুল করেই মিসটেক হয়, খাই দাই ফূর্তি করি, বিবাহিত ব্যাচেলার, গুজবে কান দিবেন না, স্টপ মামা লাইসেন্স আছে, দাদা খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন এমন বিভিন্ন লেখার গেঞ্জি বিক্রি হতে দেখা যায়।

পাইকারী বিক্রেতা ইব্রাহিম বিডিমর্নিং এর এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা ফেসবুকে যে সব বিষয় বেশি ভাইরাল হয়। সেসব বিষয়গুলো গেঞ্জিতে তুলে ধরার চেষ্টা করি। ফলে বিক্রিও বেশি হয়।

কীভাবে বুঝেন কোন লেখাগুলো বেশি বিক্রি হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করতে করতে শিখে গেছি। তবে তিনি জানান, একটা লেখা অল্প কয়েকদিন চলে। ফলে নতুন কোন ডিজাইনের লেখা খুঁজে বের করতে হয়।

রূপগঞ্জ থেকে পোশাক কিনতে এসেছেন খুচরা বিক্রেতা আবদুর রহিম। তিনি একটি পাইকারী দোকানে এসেই খোঁজ নিলেন ‘মদ খা মানুষ হ’ লেখা গেঞ্জি আছে কী না। কেন এমন গেঞ্জি খুঁজছেন জানতে চাইলে তিনি বিডিমর্নিংকে তার ভাষায় বলেন, অনেক পাগল ছাগল আছে যারা এসব চাই। সে কারণে রাখতে হয়।

একই কথা জানালেন পাইকারী বিক্রেতা কামাল। তিনি জানান, তরুণরা বেশি এসব গেঞ্জি কিনে থাকে। তবে সেটা কিন্তু বেশি দিন থাকে না।

এখানেই একটি দোকানে কাজ করেন শুভ নামের এক তরুণ। ‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’। এমন লেখা গেঞ্জি পড়ে দোকানে কাজ করছিল সে। কেন এমন গেঞ্জি পড়েছে জানতে চাইলে সে বিডিমর্নিং এর এই প্রতিবেদককে সে জানায়, তার কাছে এই লেখা গেঞ্জি ভালো লাগে।  এই গেঞ্জি পরে রাস্তা দিয়ে  যখন যায়। তখন কেমন লাগে জানতে চাইলে শুভ জানায়, সবাই তাকায় থাকে কিন্তু তার কাছে ভালো লাগে।

শুভ নামের ওই ছেলের সাথে কথা বলতে বলতেই এক খুচরা বিক্রেতা পাইকারী দোকানদার কামালকে জানালেন, এমন লেখা গেঞ্জি বিক্রি বাদ দিতে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এমন লেখা গেঞ্জি গায়ে থাকায় এক ছেলেকে পুলিশ চড়-থাপ্পর দিয়েছে।

তার কথা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছে না। কিন্তু তরুণরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়গুলো কেন বাস্তবে নিয়ে আসছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মো: আনোয়ার হোসেন বিডিমর্নিংকে বলেন, সামাজিক একটা পরিবর্তন হচ্ছে। ফেসবুক বিশ্বায়নের একটি অংশ। এটা পৃথিবীকে উন্মুক্ত করে দেয়া এবং মত প্রকাশের ক্ষেত্রেও ফেসবুক কানেক্ট(সংযুক্ত)  হয়েছে। ফেসবুক, হলিউড, বলিউড এবং বিজ্ঞাপন সবকিছুই এক সূত্রে গাঁথা। ফলে এখানে কোন কিছু দেখলে সেটা আমরা আমাদের জীবনেও সেটি সংযুক্ত করার চেষ্টা করি। ফেসবুকের কোন কমপোনেন্ট(বিষয়বস্তু) দেখছি। সেটা কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের চিন্তা চেতনাকে ওইদিকে ডাইভার্ট করছি। এগুলো বৈশ্বিক সংস্কৃতির অংশ।

সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এগুলো একটা শ্রেণির মানুষ তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থ হাসিল করার জন্য পোশাক পরিচ্ছেদসহ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে থাকে।

এগুলো সামাজিক অবক্ষয় না বলে এক ধরনের পরিবর্তন হিসেবেই দেখেন তিনি। তিনি বলেন, তখনই এটাকে অবক্ষয় বলা যাবে যখন এই ধরনের বিষয়গুলো  পারিপার্শ্বিক জগৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আহত করছে। কিন্তু এগুলো যদি তার মননকে পরিবর্তন করে, তাকে উদার করে তাহলে কিন্তু ইতিবাচক। তবে অনেক লেখাও সামাজিক অবক্ষয় হিসেবে বলতে চান এই অধ্যাপক। যেখানে মেয়েদেরকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

পোশাকে বিভিন্ন লেখা উক্তি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দেখা যায়। থাকে দেয়ালিকা, গ্রাফিতির মতো বিষয়ও। সেসব লেখার মধ্যে সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার অনেক চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। মনীষীদের উক্তিও প্রধান্য পায় সেসব লেখায়। থাকে নিজেদের দাবি-দাওয়া সংবলিত বিভিন্ন লেখা। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পর বিক্রি হতে দেখা যায় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ লেখা টি-শার্ট। তবে তরুণরা যে এমন সব বিষয় গুলো নিজেদেরকে ‘অদ্ভুতভাবে’ উপস্থাপন করার জন্য কিনছে তাদের ওপর গবেষণা করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সমাজ ও মনোবিজ্ঞানের গবেষকরা।

Bootstrap Image Preview