Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৪ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘কাফের বলেই আমাদের ধর্ষণ করত তারা’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:০০ PM
আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:০০ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জঙ্গিদের ‘যৌন দাসী’ নাদিয়া মুরাদ। এর আগে ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এই নাদিয়া মুরাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি। সাংবাদিক সারা মন্তেগু ‘বিবিসি হার্ডটক’র জন্যই তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। শুক্রবার সেই নাদিয়ার নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই ইন্টারভিউটি নতুন করে তুলে ধরে বিবিসি। সেই সাক্ষাৎকারে নাদিয়া জানান,

সালটা ২০১৪। ৩ আগস্ট। ‘দায়েশ’ আমাদের শিঞ্জর গ্রামে ইয়াজিদিদের উপর আক্রমণ করে। এর আগে, ওরা ইরাকের তাল আফার আর মসুলে হানা দেয়। শিয়া আর খ্রিস্টানদের ধরে ধরে বের করে। দুটো শর্ত ছুড়ে দিয়েছিল সামনে– হয় ঘর ছাড়ো, নয়তো টাকা ফেলো খাজনা স্বরূপ। অধিকাংশ মানুষই বেরিয়ে পড়ে চুপচাপ। শিঞ্জরে হানা দিয়ে কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, প্রায় ৩০০০ জন পুরুষকে ওরা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে। আটক করে শিশু ও বৃদ্ধাদের।

আমাদের গ্রাম পাহাড়ের থেকে দূরে ছিল। আমরা আর পালাতে পারলাম না, দায়েশরা আমাদের ধরে নেয়। পুরো দলছুট আর কোণঠাসা হয়ে যাই আমরা। পরের কয়েক দিন ওরা গ্রাম ঘিরে থাকে। কেউ বেরতে পারিনি। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ভয়ংকর কিছু একটা হতে চলেছে। আমরা নেট, ফোন সবরকম উপায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি বাইরের জগতের সঙ্গে। কিন্তু সাহায্য পাইনি। আরও কিছুদিন পরে দায়েশরা আমাদের গ্রামের হাই স্কুলে আটকে রাখে। এবার শর্ত: হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, বা মৃত্যুকে বেছে নাও। তারপরই ওরা নারী-পুরুষদের আলাদা করে দিল। প্রায় ৭০০ পুরুষকে গ্রামের প্রান্তে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারল। বাজেয়াপ্ত করল গয়নাগাটি, সম্পদ।

তিনি আরও বলেন, চার বছর বা তার চেয়ে ছোট বাচ্চা ছেলেদের ওরা রেখে দিল। আর, মেয়েদের নিয়েছিল- যারা নয় বছরের বেশি। এমনকী, আশি বছরের বৃদ্ধাদেরও ছাড়েনি। তাদের মধ্যে আমার মা-ও ছিল। কেউ বলে, ওদের মেরে ফেলেছিল। কেউ বলে, মারেনি। অন্য কোথাও পাচার করে দিয়েছিল। সত্যি খবরটা কেউই জানি না। কিন্তু এই দু’মাস আগে, শিঞ্জরের কিছুটা এলাকা যখন উদ্ধার করা গেল উগ্রপন্থীদের হাত থেকে, মাটির তলায় কয়েকশো দেহ খুঁজে পাওয়া গেল। আমার পরিবারের ১৮ জন হয় মৃত কিংবা নিখোঁজ। অবশ্য দায়েশের আক্রমণে যতজন প্রাণ হারায়, প্রত্যেকেই তো আমারই পরিবার।

নাদিয়ার আরও জানান, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একজনকে, কেন এরকম করছে তারা। কেন খুন করে দিল গ্রামের পুরুষদের? কেন ধর্ষণ করছে আমাদের? ওরা একটা কথাই বলছিল বারবার– ইয়াজিদিরা ‘কাফের’। আমরা যুদ্ধের উচ্ছিষ্ট। এর চেয়ে ভাল আচরণ আমাদের মানায় না। ইয়াজিদিদের সমূলে উপড়ে দেওয়াই তাদের কাজ। সেই কর্তব্যই তারা পালন করে চলেছে।

আমাদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বাসে করে মসুলে নিয়ে গেল জঙ্গিরা। আমার দলে ছিল ১৫০ জন, সেখানে আমার তিন ভাইঝিও ছিল। যাওয়ার পুরো সময়টা জুড়ে তারা আমাদের বুকে হাত দিচ্ছিল, দাড়ি ঘষছিল আমাদের গালে। আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কী করতে চলেছে তারা আসলে! কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছিল যে, ভালো কিছু মোটেও হবে না আমাদের সঙ্গে। যারা মানুষ খুন করে, বয়স্কদেরও রেহায় দেয় না, তাদের কাছে ভালো কিছুর প্রত্যাশা অন্ধের স্বপ্ন দেখার সমান।

মসুলে পৌঁছে ওদের হেড কোয়ার্টারসে তোলা হয় আমাদের। বিশাল জায়গা। কমবয়সি মেয়ে আর শিশুতে ভর্তি। প্রত্যেকেই ইয়াজিদি। একজন বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আগের দিনই তিনি একটি গ্রুপের সঙ্গে এখানে পৌঁছেছেন। ৪০০ জনের গ্রুপ। প্রত্যেক ঘণ্টায় দায়েশের লোক আসছে আর নির্মমের মতো এক-একটা মেয়েকে বেছে নিয়ে যাচ্ছে। পরের পর ধর্ষণ। কোনও কোনও মেয়েকে বিক্রিও করা হয়েছে।

পরের দিন দায়েশের কিছুজন জোট বেঁধে আসলো। এবার এক-একজনের জন্য একাধিক মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। কারও বয়স আমার চেয়ে অনেকখানি কম, ১০-১২ বছর বা তার চেয়েও ছোট। আমরা যারা একটু বড়, তাদের পিছনে লুকনোর চেষ্টা করছিল বাচ্চা মেয়েরা।

এর মধ্যে একটা মোটা মতো লোক আমাকে এসে চেপে ধরলো। হিঁচড়ে নিয়ে গেল সিঁড়ির তলায়। সেই সময় আমার পাশ দিয়ে আরেকজন উগ্রপন্থী যাচ্ছিল, আমি তাকে চেপে ধরে অনুরোধ করলাম। এই মোটা মানুষটা আমাকে অন্তত না নিক। বদলে সে নিয়ে যাক আমাকে।

যে মানুষটার কাছে আমি প্রথমবার ধর্ষিত হয়েছিলাম, সেই সময়ই আমি প্রথম পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমি পারব না। তারপরেও আমি পালানোর জন্য মরিয়া ছিলাম। মসুলের সমস্ত জায়গায় দায়েশের লোক তখন ছড়িয়ে। সেবার জানলা দিয়ে আমি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। তারপর আমাকে গণধর্ষণ করা হল।

তাদের মতে, কোনও মহিলা যদি পালানোর চেষ্টা করে, তার এটাই যোগ্য শাস্তি। তারপর থেকে আমি পালানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম নাভ। মসুলে যে লোকটার সঙ্গে আমি শেষবার ছিলাম, সে একাই থাকতো। কিছুদিন ভোগের পর, আমাকে বিক্রি করে দেবে স্থির করায়, আমার জন্য কিছু জামাকাপড় এনে দিয়েছিল। আমি আবার সাহস এককাট্টা করে পালালাম। মসুলের একটি মুসলিম পরিবারের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে তারা আমাকে আশ্রয় দিল। তারা জানাল দায়েশের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসলামিক আইডি বানিয়ে দিয়ে বর্ডারে পৌঁছে দিল সেই পরিবার।

ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সদস্য ২৫ বছর বয়সী নাদিয়া আইএসের যৌনদাসী হিসেবে বন্দি ছিলেন। শুক্রবার তিনি কঙ্গোলিস চিকিৎসক ডেনিস মুকওয়েগের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই তাদের এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আলেক্সান্ডারিয়া বোমবাচের চলচ্চিত্রে নিজের সম্প্রদায়ের পক্ষে নিজের কষ্টকর কাজের অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন তিনি।

নিজের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা ওপর দিয়ে যে নিপীড়ন চলেছে, মানুষকে তা বলে বেড়ানোর কথা ছিল না আমার। বরং আমার একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, কোনো ভালো ক্রীড়াবীদ বা মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ার কথা ছিল।

আইএসএর ডেরা থেকে পালিয়ে আসা এই তরুণী পরে ইয়াজিদি জনতার মুক্তি আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হন। মালালা ইউসুফজাইয়ের পর তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে শান্তিতে নোবেল পেলেন।

Bootstrap Image Preview