Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৭ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ঢাকায় উদযাপিত হচ্ছে আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের সম্মেলন

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:৫১ AM
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:৫১ AM

bdmorning Image Preview


বিডিমর্নিং ডেস্ক-

'আদিবাসীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসুন' এই স্লোগানকে সামনে রেখে কাপেং ফাউন্ডেশন আজ ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে দিনব্যাপী আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের সম্মেলন ২০১৮ আয়োজন করেছে।

উক্ত সম্মেলনের উদ্বোধনী ঘোষণা করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান।

সম্মেলনের উদ্বোধনী সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাড. সুলতানা কামাল।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার মিসপেনী মর্টন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং। উদ্বোধনী সভাটিসভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথসরেন। সম্মেলনের এ অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং পরিচালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনেরনির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, দেশে যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে তারা এখন সবচেয়ে বেশিঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদেরকে হুমকী ও মিধ্যে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। একদিকে রাষ্টপক্ষ নিজেও মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে না, আবার যারা এসব কাজ করছে তাদের পাশে গিয়েও দাঁড়াচ্ছে না। বরং মানবাধিকারকর্মীদেরকে সরকার মাঝে মাঝে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে সম্বোধন করছে।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, মানবাধিকারকর্মীগণ কিন্তু সংবিধান মেনে নিয়েই মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাহলে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী হয় কী করে?

তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতার মুক্তির সনদেও মানুষের মুক্তির কথা বলা আছে। বরং যারা তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে কথা বলছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে আমার নিজেকে রক্ষার অধিকার আমার রয়েছে। সে চেতনাটি আমাদের মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করতে ধাবিত করে। এ কাজ করতে গিয়ে আমাদের বিভিন্নভাবে মিথ্যে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে’।

তিনি আরো বলেন, মানবাধিকার কর্মীদেরসবসময় ভয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। মানবাধিকারের কাজকে আজ ক্রিমিনালাইজড করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আদিবাসীরা এদেশে অন্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তাদের ভূমি দখল করা হচ্ছে, আদিবাসী নারীদেরনির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এখানে রাষ্ট্র তাদের পাশে না দাঁড়িয়েবরং নির্যাতনকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। একটি সুন্দর দেশ গড়ার লক্ষ্যে তিনি আদিবাসীও অ-আদিবাসী মানবাধিকারকর্মীদের একসাথে এগিয়ে এসে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধহতে আহ্বান করেন।

উদ্বোধনী বক্তব্যে ড. মিজানুর রহমান দেশের আদিবাসীদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সামনে জাতীয় নির্বাচনে যেন আদিবাসী সংখ্যালঘুরা কোনভাবেই নির্যাতন বা মানবাধিকার লঙ্ঘণের শিকার না হন সেজন্য তিনি সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে বলেন।

অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার মিস. পেনী মর্টন বলেন, অস্ট্রেলিয়ান সরকার আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় খুব তৎপর এবং অস্ট্রেলিয়ায় এবং সারবিশ্বে সে সরকার বিভিন্নভাবে কাজকরে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়া সরকার আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র(ইউএনড্রিপ) সমর্থন করেছে। এদেশেও অস্ট্রেলিয়ান সরকার বাংলাদেশ সরকার ও নানা এনজিওদের সাথে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে অস্ট্রেলিয়া এ্যাওয়াডর বৃত্তি আদিবাসীদের জন্য ১০% কোটা সংরক্ষিত থাকবে। তিনি সম্মেলনের সফলতা কামনা করেছেন।

সঞ্জীব দ্রং বলেন, একটি রাষ্ট্র কতটুকু মানবাধিকারে দিক থেকে উন্নত তা দেশের সংখ্যালঘু আদিবাসীদের মানবাধিকার অবস্থা পর্যালোচনা করলে জানা যায়। আমাদের দেশে আদিবাসীরা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘণের শিকার হন। আদিবাসীদের অবস্থা উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি মূল স্রোতধারা বাঙালিমানুষের সমর্থন প্রয়োজন।

এছাড়াও এ অধিবেশনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন মানবাধিকারকর্মী ইউজিন নকরেক, জন ত্রিপুরা ও চন্দ্রা ত্রিপুরা।

রবীন্দ্রনাথ সরেন উদ্বোধনী অধিবেশনের সভাপতির বক্তব্যে বলেন, দেশে আদিবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তাদের ওপর বিভিন্ন নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-হামলা, ভূমি দখল, উচ্ছেদ ইত্যাদি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এই অবস্থায় আদিবাসীরা এগিয়ে যাচ্ছে বলে সরকার চাকরি ক্ষেত্রে আদিবাসীকোটা তোলে দেয়ার যে প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছেন তার বিরোধিতা করেন। তিনি আদিবাসী অধিকার আদায়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেন। আগামী নির্বাচনে আদিবাসী নির্যাতনকারী ও ভূমিদখলকারী প্রার্থীদের তিনি বয়কট করতে বলেন। তিনি আদিবাসী যুব সমাজকে অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহবান করনে।

এছাড়াও সম্মেলনের দিনব্যাপী আলোচনায় ২য় অধিবেশনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আইপিএইচআরডি সদস্যরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে গিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশনে আইপিএইচআরডি নেটওয়ার্ক কিভাবে কাজ করবে তার একটি কৌশলপত্র পরিকল্পনা তৈরি নিয়ে আলোচনা হয় এবং পরিশেষে সমাপনী অধিবেশও রয়েছে।

সমাপনী অধিবেশনে আদিবাসী সংগঠন ছাড়াও দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন এবং এ সম্মেলনে একটি ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হবে। এ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সারাদেশ থেকে প্রায় ১০০ জন আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীগণ অংশগ্রহণ করেন।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। দেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি এতোটাই করুণ যে, আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতামূলক কার্যক্রম অনবরত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম,গারো পাহাড়, উত্তরবঙ্গ, গাজীপুর, মধুপুর বনাঞ্চল, পটুয়াখালী-বরগুণা, সিলেট-মৌলভীবাজার অঞ্চল সর্বত্র আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি হারিয়ে চলেছে। আদিবাসীদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাতো দূরের কথা, আত্ম-পরিচয় ও নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। এই ৪৭ বছরেও আদিবাসী মানুষের জীবনে জাতিগত, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিকনিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ ও অত্যাচারের অবসান হয়নি। ২০১৬ সালের নভেম্বরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উপর ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যার পর কোনো বিচার না হওয়ায় উচ্ছেদকৃত অনেক আদিবাসী পরিবার এখনও মানবতের জীবনযাপন করছেন। ২০১৭ সালের জুনে সংঘটিত রাঙ্গামাটির লংগদুতে সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যার কোনো বিচার এখনও হয়নি। খাসিয়া আদিবাসীরা এখনও শ্রীমঙ্গলেরনাহার ও কাইলীন পুঞ্জি, কুলাউড়ার ঝিমাই পুঞ্জিতে অনিশ্চিত জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন এবং মিথ্যা মামলা ও নানা রকম হয়রানি মোকাবেলা করছেন। মধুপুর গড় অঞ্চলের ২০ হাজারের অধিক একর আদিবাসী ভূমি রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার ফলে সেখানকার আদিবাসীরাও অনিশ্চয়তার মধ্যেরয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাপেং ফাউন্ডেশন২০১৭ সালেই এরূপ ৫৭ জন আদিবাসী ভিকটিমের ৪৮টিরও অধিক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে। এবছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ৪১জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ,গণধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের মতে, বান্দরবান জেলার আলিকদম-থানচির মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকার কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক আদিবাসী নিরাপত্তার অভাবে মিয়ানমারে দেশান্তরিত হয়েছেন।উত্তরবঙ্গে কয়েকশত আদিবাসী, সাম্প্রদায়িক হুমকি ও আক্রমণের কারণে এবং ভূমিদস্যুদের ভয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থা আরও সংকটজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক আশা নিয়ে ১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিরমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, এ চুক্তির ২০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মৌলিক বিষয়গুলো এখনও অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।এসব কিছুর পরও আদিবাসী জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে।

Bootstrap Image Preview