Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৩ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

গায়েব ডাকসুতে হামলার সিসিটিভি ফুটেজ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৩০ AM
আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৩০ AM

bdmorning Image Preview


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু ভবনে মোট ৯টি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। অথচ গত রবিবার ডাকসু ভবনে প্রবেশ করে ভিপি নুরুল হক নুর ও তার সঙ্গীদের ওপর ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ ও ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী যে হামলা চালিয়েছে, সেই হামলার ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে। সঙ্গীসহ নুরকে তার কক্ষে আটকে মারধরের পর কে বা কারা এসব কাণ্ডের ফুটেজ নিয়ে গেছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, হামলার পর ঢাবি ছাত্রলীগের এক শীর্ষনেতার তত্ত্বাবধানে সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ হার্ডডিস্ক, মনিটর ও সিপিইউ ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে দেখেছেন তারা। এ হামলার ঘটনা তদন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে ৬ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে নুর ও তার সঙ্গীয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রাচ্যের বাতিঘরখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস গতকাল ছিল উত্তাল। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রাব্বানীকে অপসারণ এবং হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে দিনভর বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে পুলিশ গতকাল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আল মামুুন এবং ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্যকে গ্রেপ্তার করেছে। আল মামুন ছাত্রলীগের গত

কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপসম্পাদক ছিলেন। আর তূর্য ঢাবি ছাত্রলীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক। ভিপি নুরের অভিযোগ, হামলার মূল নায়ক ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিতচন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি সবার আগে এ দুজনকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।

হামলায় গুরুতর আহত ৫ জনের উন্নত চিকিৎসায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রাজিউল হককে প্রধান করে ৯ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন গতকাল এ তথ্য জানান।

রবিবারের এ হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মারামারি শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা পর সহকারী প্রক্টর আবদুর রহীম, বদরুজ্জামান ভূঁইয়া ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও তারা হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হন। তাদের উপস্থিতিতেই নুরের সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর প্রক্টর হামলাস্থলে পৌঁছেন এবং আহতদের মধ্যে ১০ জনকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তবে ভিপি নুর ও রাশেদ ফারুক তখনো ভিপির কক্ষে আহতাবস্থায় পড়েছিলেন।

প্রশাসনের ভূমিকার বিষয়ে আহত রাশেদ খান বলেন, আমাদের মারধরের আগে প্রক্টরকে আমি কয়েকবার কল করি। এর মধ্যে তিনি তিনবার কল ধরেন। সব কিছুই হয়েছে প্রক্টরের অবহেলার জন্য। আমরা মারা গেলে তার জন্য তিনিই সর্বপ্রথম দায়ী থাকতেন।

এ হামলার ঘটনায় গতকাল সোমবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রঐক্য’র ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে দুপুর ১২টার দিকে রাজু ভাস্কর্য থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণের পর প্রক্টর অফিসের সামনে বেশকিছু সময় অবস্থান নেয়। সেখান থেকে মিছিলটি ফের রাজু ভাস্কর্যে ফিরে আসে।

এর পর সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশের ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী প্রমুখ।

সমাবেশ থেকে হামলায় জড়িতদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, দায়িত্বে অবহেলার দায়ে প্রক্টরকে অপসারণ এবং হামলাকালীন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশের দাবি জানানো হয়। আজ মঙ্গলবার বেলা ৩টায় একই স্থানে ছাত্র-জনতার সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে।

বিক্ষোভ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রশাসন ও তাদের মদদে তৈরি হওয়া তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কাদের স্বার্থরক্ষায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহার করে এমন হামলা মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট অপমান।

এদিকে ঢাবি ক্যাম্পাস গতকাল সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল থাকলেও এদিন অনেকটাই নীরব ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্রলীগের কিছু অতিউৎসাহী নেতাকর্মী এ হামলায় মদদ দেয়। তারা হামলার সময় এগিয়ে না গেলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের স্বল্পসংখ্যক নেতাকর্মী এমন দুঃসাহস দেখাতে পারতেন না। সরেজমিনে ঢাবি ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্র ও ঢাবি শাখার নেতারা মধুর ক্যান্টিনে এলেও অন্যান্য দিনের তুলনায় গতকাল সংগঠনটির নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল অনেক কম। আর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কোনো নেতাকর্মীকেই ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।

হামলার ঘটনায় সরাসরি ছাত্রলীগকে দায়ী করে ডাকসু ভিপি গতকাল তার ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমাদের ওপর গতকালের (রবিবার) হামলার মূল নায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিতচন্দ্র দাস এবং সেক্রেটারি সাদ্দাম হোসেন। তাদের দুজনের নেতৃত্বেই আমাদের ওপর হামলা করা হয়। সবার আগে এ দুজনের গ্রেপ্তার দাবি করছি। অন্য কোনো সাজানো নাটক বাংলার ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ভিপি নুর ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার সময় ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের দুই শীর্ষনেতা সনজিতচন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছাড়াও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী অংশ নেন। তাদের মধ্যে এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খান মিলন হোসেন নিরব, সূর্যসেন হল সংসদের ভিপি মারিয়াম খান সোহান, জিএস সিয়াম রহমান, স্যার এফ রহমান হল সংসদের জিএস আবদুর রহিম, বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হল সংসদের এজিএস আবু ইউনুস, কবি জসীমউদ্দীন হল সংসদের ভিপি ফরহাদ হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমরান আহমেদ, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক হৃদয় হাসান সোহাগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, মঞ্চের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্য, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপস্কুল-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক খাজা খায়ের সুজন প্রমুখ মারধরে অংশ নেন। হামলায় নুরসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন।

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমরা ক্যাম্পাস শান্ত রাখার পক্ষে। এর পরও কোনো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর নাম এলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

এদিকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব হয়ে যাওয়া সম্পর্কে ডাকসুতে দায়িত্বরত সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ভিপি নুর যখন ডাকসুতে ঢোকেন তখন আমাকে মূল গেট আটকে দিতে বলেন। আমি গেট আটকে দৌড় দিয়ে প্রক্টরের কাছে যাই। প্রক্টর স্যার অফিসে ছিলেন না। পরে প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা রেজা আমাকে গেট বন্ধ করে দিতে বলেন। অনেক সময় গেট বন্ধ করে রাখি।

একপর্যায়ে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ও ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিতচন্দ্র দাস এসে গেট খুলে দিতে বলেন। আমি গেট খুলে দিয়ে দৌড়ে ফের প্রক্টর অফিসে গিয়ে স্যারকে বলি গেট তো খুলে দিয়েছি, মারামারি হতে পারে। তখন তিনি পুলিশে খবর দিয়েছেন বলে আমাকে জানান। এ কথা শোনার পর দৌড়ে ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কাছে যাই। কিন্তু তিনি সে সময় অফিসে ছিলেন না। স্যারকে না পেয়ে প্রায় দুটোর দিকে ফিরে দেখি, আমার রুমের দরজা ভাঙা। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণের হার্ডডিস্ক, মনিটর, সিপিইউ কিছুই নেই।

এ বিষয়ে ডাকসুর অন্য স্টাফদের জিজ্ঞাসা করলে তারা সেখানে ছিলেন না বলে জানান। পরে ফের বেলা ৩টার দিকে প্রক্টরকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজের বিষয়ে জানাই।’

ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী গতকাল বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি কাম্য নয়। শুধু তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সব পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তিনি আরও জানান, আহতদের দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন এবং বহিরাগতসহ সবার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

Bootstrap Image Preview