হিরো আলম সাহেব ভাগ্যবান মানুষ। এ যাবৎ তার অভিনীত কোন গানের কিংবা নাচেন দৃশ্য দেখিনি। আসলে ব্যস্ততার কারণে কোনো নাটক, সিনেমা এমনকি ঠিকমতো নিজের আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজনদের সাথে ও যোগাযোগ হয় না। হিরো আলমকে নিয়ে এখন বিভিন্ন পত্রিকায়, অনলাইন ও টিভি চ্যানেলে যেভাবে সংবাদ প্রকাশে একাট্টা হয়েছে, আলম আসলেই ভাগ্যবান বটে।
আমাদের দেশের বড় মাপের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ডাক্তার, স্থপতি ও শিক্ষকদের কোনো একটা বিশেষ দিনে কিছুটা ঢিলেঢালা মতে এক প্রকার দায়বদ্ধতায় সন্মান জানায়। টুকটাক কিছু বলে টলে চা নাস্তা খেয়ে, কিংবা বিরিয়ানি, খিচুড়ির ঢেঁগুড় তুলে চলে আসে। আবার আগামী সময়ের প্রহর গুণে। কিন্তু হিরো আলম এতোটাই ভাগ্যবান যে, প্রতিদিনই তাকে নিয়ে মাতামাতি সাক্ষাতকার, এইরি মধ্যে হিরো আলমের ভাস্কর্যও কমপ্লিট। তাঁর মোমের মূর্তিও একদিন লন্ডনের জাদুঘরে হয়তো স্থান পাবে!
আমাদের পবিত্র সংবিধান ও আইন পাশের বিষয়ে হিরোকে কেউ প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কিছু কিছু মুখস্থ করা আর্টিকেল বলতে পারতেন। পারতেন এ কারণেই যে, মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। হিরো আলম জানেন, বোঝেন, পারেন এ জাতীয় কিছু টুকটাক মিথ্যা প্রতারনার আশ্রয় নিতে পারতেন। না হিরো আলম তা কিন্তুু করেননি। তিনি স্ব-মহিমায় থেকেছেন। আগের যে ডিশ আলম সেভাবেই আছেন।
এখন আসি প্রখর মেধাবীদের কথায়। জাপানে শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদায় শতভাগ উচ্চ শিখরে রাখা হয়। অন্যান্য দেশে ও তা কোন অংশে মর্যাদায় কমতি নেই। বাংলাদেশেও জাতির বিবেক মহান শিক্ষকতা পেশাকে সবাই সন্মানের চোখে দেখি। এ মহান পেশায় কিন্তু একজনও হিরো আলম নেই। আমরা সবাই এঁনাদের নিকট হতে হাতেখড়ি নিয়েই শিক্ষাজীবনের শুরু করি। এঁনাদের নিকট হতে শেখা, গুরুজনে কর নতি, ক্ষমা মহত্বের লক্ষন, সর্বদা স্বীয় জিহ্বা শাসনে রাখিবে, মানীর অপমান বজ্রাঘাত তুল্য, অহংকার পতনের মূল, পিতা মাতাকে সর্বদা সন্মান করিও। আমাদের নীতিবোধ, আদর্শ ও বিবেক ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা এক কথায় শিক্ষা গুরুদের নিকট হতে পেয়েছি। এক কথায় মাতা, পিতার পরেই শিক্ষকদের মর্যাদা ও স্থান।
আমরা এঁনাদের কাছে কতোই না নিরাপদ! আজ মিডিয়া ও পত্রিকান্তরে দেখতে পেলাম, মোবাইলে নকল করার দায়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর সামনে তার বাবাকে অপমান করায় ও টিসি দেবার সিদ্ধান্তে কোমলমতি মেয়েটি কষ্টের সীমাহীন অব্যক্ত যন্ত্রণা সইতে না পেরে, চলে গেলেন পরপারে...। না অরিত্রী আর ফিরবে না, কাঁদবে না, শিক্ষকদের পায়ে ধরবে না, বাবাকে আর কোনদিন অপমানিত হতে দেবে না। সহপাঠীদের সাথে দুষ্টুমি করবে না, ফুসকা খাবার আবদার করবে না।
অরিত্রীর স্থলে যদি স্কুলের শিক্ষকদের কোনো সোনামনি হতো, টিচার কি করতেন? পারতেন তাকে টিসি দিতে? আপনার আপন সন্তানই যদি হতো তাহলে কি পারতেন এতোটা নির্দয় হতে? আপনি কি পারতেন তাকে টিসি দিতে? লজিক বলে কোনো দিনই পারতেন না, অপমানের কথা বাদই দিলাম।
আপনারা সুশিক্ষিত বটে। স্ব-শিক্ষিত হওয়াটা বাঞ্চনীয় নয় কি? আপনারা আমাদের মানবীয়তা শেখান, নীতিবাক্য আওড়ান, নীতিবাক্য আদর্শ কথায় প্রশ্ন করেন, লেখান, সিংহ ও বকের নীতিবাক্য শেখান, হারান ও পরান মাষ্টারদের নীতিবাক্য নিয়ে বাক্য রচনা শেখান। একেবারে নতুন আঙ্গিকে বিবেক জাগ্রতকারী প্রশ্নবানে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নম্বর দেন? আরো কতো কি? আপনাদের নতুন নতুন লেসনে ছাত্র ছাত্রীদের ভয়ার্ত চাহনিতে নিজেদের কথিত কৃতিত্বের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন? অভিভাবকদের সাথে চাকর বাকরের মতো ব্যবহার করেন? বেচারা অভিভাবকেরা সন্তানদের আপনাদের একরোখা ব্যবহারের পরে ও সন্তানদের পড়াশোনার চিন্তা করে হাসিমুখে বলেন, স্যার আমার সন্তানকে একটু দেখবেন, শিক্ষকদের পরম শ্রদ্ধায় বৈষ্ণব বিনয়ের সাথে তুষ্ট করেন! পাছে শিক্ষক মশাই যদি গোস্বা করে কিছু করেন? (নামিদামি স্কুল কলেজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)।
জানি আপনাদের যথাযথ শাস্তি হলে ও অরিত্রি আর ফিরবে না, তার অতৃপ্ত আত্মার বিলাপের কান্নাগুলো কেউ শুনবে না। কিন্তুু শুনতে পাবে, অরিত্রীর বাবা-মা। কারণ তাকে কতো স্নেহের পরশে কতো স্বপ্নের সমান উচ্চতা ঘিরে রচনা করেছিল সাফল্যের স্বপ্নগাঁথা।
আজ বাংলাদেশের নামিদামি স্কুলগুলোর কথিত স্কুল কমিটির মনগড়া সিদ্ধান্ত, কমার্শিয়াল চিন্তা, চা পানের আসর, শিক্ষকদের পাঠদান, তাদের অমার্জিত ব্যবহার, অপেশাদারিত্ব আচরণ, শিশুদের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর, কর্কশ ভয়ার্ত আচরণের পাঠদান পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
আজ টিভি স্ক্রলে যখন কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীরা অরিত্রীদের বাবা মায়ের বিলাপ শোনতে পায়, তারা কি স্বাভাবিকভাবে পাঠ গ্রহণ করতে পারবে? তারা কি শিক্ষকদের ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ নীতিবাক্যে বিশ্বাসী হবে?
জানি না তারা কিভাবে নীতিবাক্য বিশ্বাস করবে? কারণ বাংলাদেশে বর্তমান শিশু আইনে মারাত্মক ফৌজদারী ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে ও শিশুদের শাস্তির বদলে সংশোধন, তাৎক্ষণিক জামিনের ব্যবস্থা, আসামির পরিবর্তে দোষী/প্রতিপক্ষ লিখতে হয়। বকাঝকা তো দূরের কথা। সেখানে কথিত নকলের জন্য, সবার জানা।
আজ হিরো আলমদের কথাই সত্যি হলো। হিরো আলমের অহংকার নেই, সত্যি কথা বলে। চরম দারিদ্রতার কারণে মিথ্যের নীতিবাক্য বিশ্বাস করতে হয়নি। ভণ্ডামি, মিথ্যের ফুলঝুড়ি উপহার দেননি, কাউকে উপহাস করেননি, কাউকে খুন কিংবা প্রতারণা করেননি, তার কথার অপমানের ভীমরুমের বিষে কেউ আত্মহত্মা করেননি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা শিক্ষাব্যবস্থা, কথিত চা মার্কা কমিটি তথা শিক্ষকদের নীতি বিরুদ্ধতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে যদি একদিন সত্যিই পড়াশুনায় মনোযোগী না হয়ে একজন হিরো আলম হতে চায় কিনা, তা চিন্তার বিষয়!
লেখক: রাজীব কুমার দাশ, ইন্সপেক্টর, বাংলাদেশ পুলিশ