দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার শততম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে ১৮ই জুলাই, যে দিনটি নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস বলে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর জোহানেসবার্গের বাড়িতে ৯৫ বছর বয়সে নিভে গিয়েছিল এই মহান মানুষটির জীবনপ্রদীপ। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটির আজ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালের ২৫শে মার্চ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকেসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল। সেটাই ছিল বাংলাদেশে তার প্রথম এবং শেষ সফর।
১৯৯৭ সালের ২৫শে মার্চ সকালে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের অবিসংবাদিত নেতা ও দেশটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনদিনের সেই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি ছিলেন ঢাকায় তখনকার হোটেল শেরাটনে, যার নাম এখন 'হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল'। তিনি খোঁজ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটির আজ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী।
দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে তিনি 'মাদিবা' নামে বেশি পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন যুবলীগের। ১৯৪৮ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বের সামনের সারিতে আসেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে শ্বেতাঙ্গ সরকার। যাবজ্জীবন কারাদ- হয় তার। বোরেন দ্বীপের কারাগারে ২৭ বছর কাটিয়ে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান তিনি।
১৯৯১ থেকে '৯৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট।১৯৯৪ সালে তার নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়লাভ করে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন ম্যান্ডেলা। তারপরের ইতিহাস আরও উজ্জ্বল। সারা জীবন যাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, যাদের বর্ণবাদী আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছে দেশ, সেই বর্ণবাদী আফ্রিকান ন্যাশনাল পার্টির এফডব্লিউডি ক্লার্কদের নিয়ে গঠন করেন জাতীয় ঐক্যের সরকার। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি জোরালো করতে গঠন করেন ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকেসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল। সেটাই ছিল বাংলাদেশে তার প্রথম এবং শেষ সফর। ঢাকায় হোটেল শেরাটনে নেলসন ম্যান্ডেলাকে গান শুনিয়েছিলেন প্রখ্যাত লোকগানের শিল্পী ফকির আলমগীর।
হোটেল শেরাটনে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমিরের কাছে বাংলাদেশের আম খেতে চেয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। তবে মৌসুম না হওয়ায় তাকে আম খাওয়াতে পারেনি আয়োজকেরা। ১৯৭১ সালের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম নিয়ে কিছু করা হচ্ছে কিনা, সেসব জানতে চেয়েছিলেন মি. ম্যান্ডেলা। ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন ও স্বাধীনতার স্তম্ভের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মি. ম্যান্ডেলা। তার আগে অপর দুই নেতার সঙ্গে সাভারে স্মৃতিসৌধে পুষ্প অপর্ণ করেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া বক্তব্যে তিনি তিনি দক্ষিণ আফ্রিকান মানুষের সংগ্রামের বর্ণনা তুলে ধরে বাংলাদেশ ও তাদের রাজনৈতিক, বাণিজ্য আর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন। হাজার হাজার মানুষের সেই সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, 'স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের অনেক মিল রয়েছে। আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, বাংলাদেশের মানুষকেও একসময় এরকম সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। একটি দূরের দেশ হওয়ার সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের মুক্তি সংগ্রামে আপনারা যে সমর্থন দিয়েছেন, সেজন্য আপনাদের প্রতি আমি তাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই।'
নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গান গেয়েছিলেন বাংলাদেশের গায়ক ফকির আলমগীর। গানটি লিখেছিলেন সেজান মাহমুদ। ফকির আলমগীর বলেন, সেই গানের কথা জানতে পেরে তার সঙ্গে নিজে থেকেই দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন মি. ম্যান্ডেলা। সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন পেয়ে সস্ত্রীক তার সঙ্গে দেখা করে সেই গান শুনিয়েছিলেন ফকরি আলমগীর। তার গানের সঙ্গে আফ্রিকান ঐতিহ্যবাহী নাচ নাচতে শুরু করেন ম্যান্ডেলা।
২৭শে মার্চ নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে আবার ফিরে যান। এরপরে আর তার বাংলাদেশে আসা হয়নি। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তার মৃত্যুতে বাংলাদেশেও তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছিল, যাকে সবসময়েই বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু বলে সম্বোধন করা হয়েছে।