Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

উদ্যোক্তা পরিচালক হয়ে বদলে গেছে শিউলির ভাগ্যের চাকা

হৃদয় দেবনাথ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
প্রকাশিত: ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১০ PM
আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮, ১০:১৬ PM

bdmorning Image Preview


মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহরের মৌলভীবাজার সড়কে বাবা মা এবং ছোট পাঁচ ভাইয়ের সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন শিউলি আক্তার। ছয় ভাই বোনের মধ্যে শিউলি আক্তার পরিবারে সকলের বড় তার ছোট পাঁচ ভাই রয়েছে তারা প্রত্যেকেই স্কুল এবং কলেজ পড়াশুনা করছে।

শিউলির পরিবারের আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন পড়িয়ে সংসার চালানো থেকে শুরু করে ভাইদের-পড়াশুনার খরচ পুরাটাই বহন করতে হয় তাকে। অর্থাৎ এই পরিবারে আট সদস্যের মধ্যে শিউলি আক্তারই একমাত্র উপার্জনক্ষম।প্রতিনিয়ত অভাবের সাথে যুদ্ধ করে পরিবার চালাচ্ছেন, খরচ বহন করছেন পাঁচ ভাইয়ের পড়াশুনার। ইতোমধ্যে নিজেও স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।সংসারের দারিদ্রতা দূর করতে,বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে চাকরির পেছনে হন্য হয়ে ঘুরেছেন দিনের পর দিন।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সোনার হরিণ নামক চাকরির সন্ধান তিনি পাননি। টিউশন পড়িয়ে বয়স্ক অসুস্থ বাবা মা আর পাঁচ ভাইয়ের পড়াশুনার খরচসহ সংসার খরচ চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোনোরকম কুল কিনারা না পেয়ে ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীর পরামর্শে শিউলি আক্তার শ্রীমঙ্গল পৌরসভার পৌর ডিজিটাল সেন্টারে যোগ দেন উদোক্তা পরিচালক হিসেবে। পৌর ডিজিটাল সেন্টারে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণার মধ্যদিয়ে নিজের বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন শিউলি আক্তার। বর্তমানে সমস্ত সিলেট বিভাগে শিউলি আক্তার একজন সফল উদ্যোক্তা পরিচালক।

শ্রীমঙ্গল আধুনিক পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টারে কাজ করে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন তিনি।নিজের আয়ের টাকা দিয়ে সাত সদস্যের পরিবার চালাচ্ছেন, পাশাপাশি ভাইদের পড়াশুনার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ডিজিটাল সেন্টারের উদোক্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে।কত টাকা উপার্জন হচ্ছে মাসে? প্রতিবেদকের এমন উত্তরে মুচকি হেসে শিউলি আক্তার বলেন ৩৫০০০ হাজার তবে কোনো কোনো মাসে বেশিও হয়।

শিউলি আক্তারের মা সেলিনা বেগম বিডিমর্নিংকে জানান, আমার মেয়ে শিউলি আমাদের রত্ন, দুই চার জন ছেলে যা না করতে আমার মেয়ে তা করছে। এত বড় একটা পরিবারের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব সে একাই পালন করে যাচ্ছে। পরিবারের জন্য শিউলি যে ত্যাগ করে যাচ্ছেন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

শিউলি আক্তার বিডিমর্নিংকে জানান, আমি ২০১৫, সালে জেলায় শ্রেষ্ঠ ২০১৭,সালে বিভাগে শ্রেষ্ঠ এবং ২০১৮ সালে আবারো মৌলভীবাজার জেলায় শ্রেষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি দেশব্যাপী ই-কমার্স সম্প্রসারণের লক্ষে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটু আই প্রোগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে তৈরিকৃত "এক শপ" একটি ইন্টিগ্রেটেড ই- কমার্স প্লাটফর্ম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সারা বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল অর্জন করেছি।

তিনি আরও বলেন, শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তার সম্মাননা লাভ করে আমার কাজের প্রতি আগ্রহ, উৎসাহ আরো অনেক গুন বেড়ে গেছে। তিনি জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটু আইয়ের উদ্যোগে ই-কমার্স মার্কেট প্লেস একশপ, সৌভাগ্যক্রমে সেই একশপের পাইলট প্রকল্পের একজন সন্মানীয় সদস্য হতে পেরেছি আমি। এই ডিজিটাল সেন্টারে কাজ করে আমি ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ,পরিবারের খরচ সহজেই বহন করতে পারছি পাশাপাশি নিজেও মাস্টার্স এ পড়াশুনা করছি। আজ আমি খুব সুখি কারণ আমার মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। এভাবেই সবার সাহায্য এবং সহযোগীতা নিয়ে জনগণের দোড় গোড়ায় সব সেবা পৌছে দিয়ে সফলতার সাথে কাজ করতে চাই।এবং সব শেষে একজন ভালো মানুষ হতে চাই।

বেকারদের উদ্যেশ্যে শিউলি আক্তারের পরামর্শ হচ্ছে চাকরি নামক সোনার হরিনের পেছনে না দৌড়ে যে কেউ কম্পিউটারের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে কাজ করে সচ্ছলভাবে পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করতে পারেন!তিনি আরো বলেন এটাই একমাত্র প্লাটফর্ম যেখানে ইচ্ছে থাকলেই যে কোনো চাকরির বেতন থেকে পাঁচগুন অর্থ আয় করা সম্ভব। শিউলি জানায় ইতোমধ্যে অনেক ছেলে মেয়ে এ পেশায় আসতে শুরু করেছে!

পৌর ডিজিটাল সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এখানে ই-মেইল ও ইন্টারনেট, জন্ম-নিবন্ধন ফরম পূরণ, ফটোকপি, লেমেনেটিং, ছবি তোলাসহ নানা সেবা পাওয়া যায়। ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি এ ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়। তার কিছুদিন পরই উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয় এখানে।তাই প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ সেবা নিতে আসেন এ ডিজিটাল সেন্টারে। সরকারি বিভিন্ন দফতরের কাজও করা হচ্ছে এখান থেকেই।

আজ সকালে সরেজমিন শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, শিউলি আক্তার কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থীকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এসময় কথা হয় শিউলি আক্তারের সঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের উদ্যোগের কারণে আমি বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখান থেকে প্রতি মাসে ভালো টাকা আয় করছি। এখন আর সরকারি চাকরির কথা ভাবছি না। প্রতিদিন লোকজনের সেবা দিতে দিতে সময় চলে যায়। তবে একাজটি করতে পেরে আমি খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করি।

মহসিন আলী নামে স্থানীয় একজন কৃষক বিডিমর্নিংকে জানান, আমার বেশিরভাগ আত্মীয় লন্ডনে বসবাস করে তাই গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজই আমি পৌর ডিজিটাল সেন্টার থেকে সহজে করে নিতে পারছি। এলাকার অনেক মানুষই এখান থেকে উপকৃত বলে জানান তিনি।মহসিন আলী আরো জানান, এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষ বিদেশে থাকায় প্রায় প্রত্যেকের আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই ডিজিটাল সেন্টারে এসে করে নিতে পারেন।

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মহসিন মিয়া মধু বিডিমর্নিংকে বলেন, তথ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার এ ডিজিটাল সেন্টার চালু করেছে।এই ডিজিটাল সেন্টার থেকে প্রচুর মানুষজন সুবিধাভোগ করছেন। তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গল পৌরসভাকে তিন তিন বার জেলা এবং বিভাগে শ্রেষ্ঠ করে আমাদের সুনাম বৃদ্ধি করেছে শিউলি আক্তার। সে আসলেই অত্যান্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী যার ফলশ্রুতিতে আজ সে এ অর্জন বয়ে নিয়ে এসেছে।ভবিষ্যতে আরো ভালো করার জন্য আমাদের পৌর কর্তৃপক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম বিডিমর্নিংকে জানান, এ ডিজিটাল সেন্টার চালু হওয়ার ফলে শুধু শিউলি আক্তারই নন সমস্ত জেলায় কয়েকশো বেকার ছেলে-মেয়ের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। তারা বেশ ভালো উপার্জনও করছেন।পরিবার নিয়ে সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন তারা।

উদ্যোক্তা শিউলি আক্তার সম্পর্কে জেলা প্রশাসক তোফায়েল আহমেদ বিডিমর্নিংকে বলেন, পরিবার নিয়ে বেশ সমস্যায় দিন কাটছিলো শিউলির।পড়াশুনা করেও চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরেছে তারপর এই ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। আজ সে সফল একজন নারী উদ্যোক্তা। তিনি আরো বলেন, শুধু শিউলি আক্তারই নয় এই জেলার প্রতিটা পৌর ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে কর্মরত কয়েকশ' উদ্যোক্তা বেশ ভালো উপার্জন করে পরিবার নিয়ে সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করছে!

Bootstrap Image Preview