Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৪ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ছেলেটা সংকটের কথা বলে আত্মহত্যা করেছে! কী অদ্ভুত!

সোহানুজ্জামান।।
প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৭:১৫ PM
আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৪৭ PM

bdmorning Image Preview
ছবিঃ বিডিমর্নিং


আত্মহননের পিছনের ইতিহাস। মানুষ কেন ঈশ্বর প্রদত্ত মৃত্যুচক্র ভেঙে নিজেই নিয়ন্তা হয় মৃত্যুর! তারই খোঁজে। আচ্ছা আমাদের চারিদিক যখন অন্ধকার হয়ে আসে তখন আমাদের কী করা উচিত? আচ্ছা "সাবস্ট্যান্স এবিউস"-ই কতোটুকু অন্ধকার ডেকে আনে? কিন্তু এ সমাজে কেউ একবারও ভেবে দেখে না "সাবস্ট্যান্স এবিউস"-এর কারণটা কী! "অপূর্ণতা-প্রাপ্তি" থেকে "পূর্ণতা-প্রাপ্তি"র মাঝের সময়ে অন্ধকার দূর না করতে পারলে কেমন হবে সেই পূর্ণতা? নিশ্চয়ই সিলিং-এর গরাদে ঝুলে থাকবে নিঃসঙ্গ দাঁড়কাক! পরিবৃত্তির সময়কালে নীরব ঘাতকদের চিনে রাখব কীভাবে আমরা? একটা মানুষ কীভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেয়! আত্মহনন কী নিছকই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উন্মাদ বিক্ষোভ, নাকি বিকার? সে কথা জানতে হলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কেও জানা জরুরী।

পাথুরে কুড়াল, ভোঁতা তীর, বাঁকা তলোয়ার, থ্রি নট থ্রি বন্দুক থেকে আভতোমাৎ কালাশনিকোভা-৪৭, গ্রেনেড, মর্টার, কামান, পারমাণবিক বোমার আঘাতে যারা মানুষ খুন করে চলেছে; তাদের আমরা স্বচক্ষে দেখতে পারছি। কিন্তু এর বাইরে; কিন্তু, মূলত ভিতরে যারা প্রতিনিয়ত হত্যা করে যাচ্ছে কোমলভাবে, তাদের কী করবেন? ভাবোদ্দীপক নকড়া-ছকড়া মনে হয় "ফ্যাট বয়ে"র চেয়ে কোন অংশে কম না।

"চিত্তক্ষোভ", "সীত্সফ্রেনীয়্যা", "বাইপোলার ডিজঅডার"---যেগুলোকে সবাই মনোগত খ্যাপামি হিসেবে বিবেচনা করছে, তাতো কোন একটি বিশেষ বিষয়ের মধ্যে আবদ্ধ নয়, সম্পৃক্ত সমাজের বহুবিধ বিষয়ের সাথে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মধ্যেই হয়তো হিসেবটা খুব ভালো মিলতে পারে। ফলে আলোচনা করতে গিয়ে যদি কেউ বলে যে আধিপত্য কি এর সাথে যুক্ত হবে? হুম; সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা দরকার । আধিপত্য ব্যাপারটাকে সবাই মূলত ক্ষমতা-কাঠামোর সাথে বিবেচনা করে।কিন্তু, সামান্য একজন ভিখিরি যে সমাজের প্রতিষ্ঠিত একজন এলিটের চিত্তক্ষোভ ঘটাতে সক্ষম হতে পারে, তা বিশ্বাস না করতে পারলে এ সব আলাপ ভণ্ডুল হবে। তাই ক্ষমতা-কাঠমোর বাইরে গিয়ে মানসিক আধিপত্যের বিষয়টাকে বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করলেই হিসেবে সহজ হয়ে যাবে।

অনেকে বলবেন, স্ব-শ্রদ্ধা গায়েব হলেই অন্ধকার নেমে আসবে--- এ কথা বলার আগে আমাদের ভেবে দেখা দরকার স্ব-শ্রদ্ধা বিলোপের কারণগুলো কোথায় লুকিয়ে আছে। সেটা কী শুধুমাত্র ব্যক্তিগত, তার প্রণোদোনাও কি ব্যক্তি-সত্তা থেকে আবির্ভূত হয়? না, এর সাথে কঠিনভাবে জড়িয়ে আছে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। সেটা বহুদিনের পারিবারিক অবস্থার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে।

বহুদিনের পারিবারিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে অভ্যস্ত ব্যক্তিটা হয়তোবা বুঝতে পারিনি যে সে অবনমনের মধ্যে আছে। কিন্তু পরিবারের বাইরে এসে পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে আসলে সুস্থ কোন পরিবেশের মধ্যে নেই। এবং ক্রমাগত অবনমনের ফলে তার মানসিক বিকার বা চিত্তক্ষোভের স্বরূপ ধরতে পারার পরেই প্রচলিত সমাজের পরিবার-শৃঙ্খলের সাথে নিজের পরিবার-শৃঙ্খল মেলাতে না পারার ফলে স্ব-শ্রদ্ধা বিলোপ হচ্ছে।

আর এভাবেই আবারো একটা অন্ধকার নেমে আসছে। গরাদ নিকটবর্তী হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মেয়ের আত্মহননের প্রেক্ষাপট এভাবেই নির্মিত হয়েছে।

বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত বই 'সুখে' দেখিয়েছেন প্রতিযোগিতা ও আত্মতুষ্টির অভাবই মানুষের অসুখের মূল কারণ। আর রাসেল যে সমাজের দেখা পেয়ে এ কথা বলেছিলেন তা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে প্রবল প্রতিযোগিতা আর অতৃপ্ত আত্মতুষ্টির বেদনাবোধ ধীরে ধীরে মানসিক বিকারের সৃষ্টি করছে। গরাদ নিকটবর্তী হচ্ছে।

দীর্ঘদিন সম্পর্কের জটিলতা যে কাউকে সহজেই ধরাশায়ী করে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক । পরিবার বা অন্য যে কারো সাথে সম্পর্কের এই টানাপোড়েন যে কাউকে নিজ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা-চিন্তার সৃষ্টি করবে। এটা পেরে ওঠা; না পেরে ওঠার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আরো এক দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। স্ব-শ্রদ্ধা কি এভাবে বিনাশ হতে হতে শূন্যে নেমে আসে না? আসে। তাহলে সিলিং আর দূরে থাকে না।

আমরা যখন আধুনিক কবিতার প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে যাই, ( যেমন, টি এস এলিয়টের 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড', ১৯২২) তখন আমরা বার-বারই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পুরো ইউরোপের মানুষের সম্পর্কের অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করি। আজ সেই যুগ থেকে আমরা আরো প্রায় একশ বছর এগিয়ে এসেছি। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বছর-মাস-দিন-ঘণ্টার শৃঙ্খলা ভেঙে "ন্যানো সেকেন্ডে" পরিমাপে রূপান্তরিত হয়েছে। আর একই সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত নানা মাধ্যম তো আছেই। এই সবকিছুই কিন্তু ক্রমশ মানুষের সম্পর্কের ফাটলের মূল কারিগর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সিলিং তখনই নিকটবর্তী হচ্ছে।

করপোরেট দুনিয়ার যে মনোভাব; তা শুধু ব্যবসাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। ছড়িয়ে গেছে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে। বাদ পড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। আহমদ ছফার উক্তি মনে পড়ছে, "নামকরা স্কুলগুলোর ছাত্ররা জ্ঞানের চেয়ে অহংকারই বেশি শেখে।" এ তো ঢাকার এলিটরূপী শিক্ষায়তনের কথা বললাম। কিছুদিন আগে তরুণ নামের ছেলেটা মারা যাবার কী
কারণ ছিল?

যতদূর জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গরীবের সম্পদ। তাহলে? কারণ ভিন্ন, তরুণের মানিয়ে নেওয়া আর না পেরে ওঠার সাথে আরো নানান বিষয়ই জড়িয়ে থাকে। তরুণ আকর্ষণীয় ছিল না, একেবারেই গ্রাম-গন্ধী তরুণ, পাস করতে পারছিল না---এইসব নানা না পেরে ওঠার দুঃসহ যন্ত্রণাবোধের চেয়ে আত্মহনন তরুণের জন্য আরামদায়ক ছিল। তরুণ চলি গেল ঈশ্বরের মৃত্যুচক্রকে আঙুল দেখিয়ে।

কিন্তু তরুণের না পেরে ওঠার কষ্টের কথা কেউ ভাবেনি। আর তার বিভাগের শিক্ষকদের সময় কোথায়! সন্ধ্যাকালীন কোর্স, দু'তিনটে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে সব ঠিকঠাক করতে গেলে তরুণের মতো সামান্য শিক্ষার্থীর দিকে তাকানোর ফুরসত কোথায় শিক্ষকের! কথা সত্য! আমার মনে পড়ছে "থ্রি ইডিয়টস" সিনেমার জয় লবোর কথা, প্রেশার বাড়ল, আর মরে গেল। কিন্তু পিছনের ইতিহাস সিনেমায় দেখতে পারি, বাস্তবে দেখি তরুণের আত্মহনন।

"পাছে লোকে কিছু বলে!"--- এই দোষে বাঙালি বহুদিন বহুভাবে ভুগতে, ভুগতে এখন বেছে নিয়েছে চরম উদ্যোগ ---আত্মহত্যা; আগে যে ছিল না তেমন নয় । ইনফেরিয়র কমপ্লেক্স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বাঙালি মানসের সাথে সবচেয়ে বেশি মিশে আছে বোধ হয়। সাম্প্রতিক আত্মহত্যাগুলো কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করার মতো বিষয় নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও অসন্তুষ্টি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝা যাচ্ছে আত্মহননের পর।

সবদিক থেকে স্বাবলম্বী ছেলেটা দেশ আর শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থার সংকটের কথা বলে আত্মহত্যা করেছে! কী অদ্ভুত! কিন্তু অদ্ভুত নয়। সামগ্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তির সূক্ষ্ম চেতনা কোনো কিছুই অগ্রাহ্য করে না। তাই পেরে না ওঠে হেরে না গিয়ে আত্মহননের মধ্যে জিততে চায় ।

এই সবকিছুর পরও যাদের কাছে সাহায্য পাওয়ার কথা ছিল তাদের কাছে সাহায্য না পেয়ে ঘৃণা যেন আরো বেড়ে যাই গরাদগামীর। তাই হতাশা আরো বাড়ে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির একটা ফারাক দুঃসহ করে তোলে জীবনকে। অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে আর আলোতে ফেরার পথ থাকে না। হারায়, সব হারায়। সিলিং-এর গরাদে ঝুলে থাকা ছাড়া আর কিছুই বাকী থাকে না।

কতোটা মর্মন্তুদ! আর তাই এই অন্ধকারের যাত্রা থামাতে হলে হাত আমাদের সবাইকেই বাড়াতে হবে। হয়তো একজনের হাত ধরেই আরেকটা জীবন বেঁচে যাবে। তাই প্লিজ, হাতটাকে ছিটকে দিবেন না, পারলে হাত বাড়িয়ে দিন। আত্মহত্যার চেষ্টা কিন্তু বাঁচতে চাওয়া মানুষটার বেঁচে থাকার অবলম্বন হারানোর গান। ফাঁস নেওয়ার আগে কেউ হাত বাড়ালে হয়তোবা বেঁচে যেতো তরুণ, নিগার, জয়েরা। প্লিজ, হাত বাড়িয়ে দিন।

লেখক: প্রভাষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Bootstrap Image Preview