Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৪ বুধবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

গোপালগঞ্জে চলছে অতিধি পাখি নিধনের মহোৎসব

এম আরমান খান জয়, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি 
প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:০০ PM
আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:০০ PM

bdmorning Image Preview


প্রকৃতিতে শীতের আমেজ শুরু হলেই রঙ-বেরঙয়ের অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত হতো গোপালগঞ্জে বিল অঞ্চলগুলো। শীত মওসুম জুড়েই দেখা যেত সাদা বক, বালিহাঁস, মাছরাঙ্গা, সারস, পানকৌরীসহ দেশি বিদেশি অসংখ্য পাখি।

খাল-বিল, জলাশয়গুলোতে পুঁটি, খলসে, মাছ খাওয়ার লোভেই নানা প্রজাতির অতিথি পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে আশ্রয় নিতো জেলার বিভিন্ন বিলে। দিগন্ত জুড়া উন্মুক্ত হাওয়ায় পাখা মেলে এক বিল থেকে আরেক বিলে উড়াউড়ি করত। অপরূপ রুপে সেজে উঠতো প্রকৃতি। মাছ আছে, দিগন্ত জোড়া বিল আছে, আসছে অতিথি পাখিও। কিন্তু এক শ্রেণির স্বার্থন্বেসী মহল পাখির এমন অবাধ বিচরণে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষটোপ-পড়শিসহ নানা প্রকার ফাঁদ পেতে নির্বিচারে শিকার করছে এ সব অতিথি পাখি। বাঁশের খুটি, কলা পাতা, খেজুর ডাল বেতের পাতা এ সব উপকরণ দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি করা ফাঁদ ৬ থেকে ৭ ফিট উঁচু। ফাঁদের সামনে বাঁশের মগডালে রাখা বক হাতে শিকারি দল বেঁধে উড়ে যাওয়া বক শিকার করছে।

এভাবেই প্রতিদিন জেলার সদর উপজেলার কাজুলিয়া বিলের বিস্তীর্ণ  ফসলের মাঠে সারি সারি করে ফাঁদ পেতে এবং বিষটোপ, বড়শি, ও বিশেষ ধরনের বাশিঁ, শিশ দিয়ে সাদা বক, বালিহাঁস, মাছরাঙ্গা, সারস, পানকৌরীসহ নানা প্রকার অতিথি পাখি শিকার করছে। প্রতিদিন বিকাল থেকে গভীর রাত আর ভোর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত এসব পন্থায় পাখি শিকার চলছে।

শুধু তাই নয়, প্রশাসনের সামনে প্রকাশ্যে হাটে নেয়া হচ্ছে বিক্রির জন্য। রাতের শেষ প্রহর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত শিকার করা হচ্ছে এসব পাখি। কেউ কেউ হাট-বাজারে ফেরি করেও বিক্রি করছে এসব পাখি। অথচ প্রশাসন রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। তারা সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বক ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা, বালিহাস ৪শ থেকে ৫শ টাকা এবং তেলকুচ পাখি ৩০০ খেকে ৪০০ টাকা এবং চাকলা পাখি প্রতিটি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পাখি শিকারি জানান, তারা গোপালগঞ্জে বিভিন্ন বিলের ফসলের মাঠে মাঠে খুঁটি পুঁতে কলাপাতা, খেজুর ডাল দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি করা ফাঁদের সামনে একটি বাঁশের মগডালে রাখা হয় শিকারি বক। আকাশ দিয়ে বকের ঝাঁক নির্মিত ফাঁদের ওপর দিয়ে দল বেঁধে উড়ে যাওয়ার সময় শিকারি তার শিকারি বকটিকে নাচাতে থাকে। এক পর্যায়ে শিকারি বকটি ডাকাডাকি শুরু করলে উড়ন্ত বকের ঝাঁকটি বিশেষ ভাবে নির্মিত ঘরের (ফাঁদ) ওপর বসে। এ সময় তারা ভেতর থেকে একে একে বকগুলোকে ধরে ধরে খাঁচায় ভরে। এছাড়া বিশেষ কায়দায় বিষটোপ দিয়েও এসব অতিথি পাখি শিকার করা হচ্ছে। 

প্রতি বছরই দেখা যায় এক শ্রেনির চোরাচালান কারি ও অসাধু ব্যবসায়ী এই পাখি নির্বিচারে হত্যা করছে। অনেকে আবার এই পাখি ধরে কেনাবেচা করেন। কেউ আবার শীতে এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

শুধু কাজুলিয়া নয়, শুক্রবার সকালে কোটালীপাড়া উপজেলার ধোরল  গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে দুইজন ব্যক্তি একে অপরে পাখি আদান প্রদান করছেন। এদর মধ্যে একজনের নাম সেলিম তিনি ধোরাল গ্রামের বাসিন্দা তার হাতে দুইটা ব্যাগ এবং ওর মধ্যে  ১৫-২০টি পাখি তার অন্য হাতে রয়েছে এরা পাচঁটি পাখি। পাশে থাকা অন্য ব্যক্তির হাতে আরো আটটি। তাদের কাছে পাখি ক্রয় বিক্রয় সর্ম্পকে  জানতে চাইলে তারা কুশলা ইউপি চেয়ারম্যারন কামরুজ্জামান বাদলের দোহায় দেন এবং বলেন আমাদের চেয়ারম্যান কিনতে বলছেন।
চেয়ারম্যানের কামরুজ্জামান বাদলের বাড়িতে গিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোন কথার উত্তন দেননি।

বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও রিাপত্তা আইন ২০১২ এ বলা আছে যদি কোন ব্যক্তি পাখি হত্যা করে তবে ওই ব্যক্তিকে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা ও এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। যদি সে পুনরায় করে তাহলে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা বা দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত।

এ আইনে আরো বলা আছে যদি কোন ব্যক্তি ইহা ক্রয় বিক্রয় বা পরিবহন করেন তাহলে  ৩০ হাজার টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদন্ড। পুনরায় করলে এক বছরের কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।  কিন্তু এই আইন থাকলেও নেই এর প্রয়োগ গোপালগঞ্জের কাজুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সাদ্দাম মোল্লা বলেন, গত সপ্তাহে পিটাবাড়ি থেকে এক পাখি শিকারিকে ডিবি পুলিশ এসে ধরে তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়ে গেছে।

পাখি শিকার সর্ম্পকে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে আনিচ্ছুক এক পাখি শিকারি বলেন, আমরা সাধারনত সারা রাত বিলে থাকি পাখি ধরার জন্য। রাত সাড়ে দশটার থেকে ভোর রাত পর্যন্ত নির্জনে বিলের মাঝে বসে পাখিররা যেবাবে ডাকে সেই পাখির ডাক অনুকরণ করে বাশিঁ বাজানো হয় এবং আমরা যেখানে বসে বাশিঁ বাজাই তার একটু দূরে ফাঁদ পাতানো থাকে। আমাদের বাসির সুর শুনে পাখি আসে এবং ফাদে আটকে যায়।

এই পাখি বস্তায় ভরে নৌকায় করে নিয়ে আসেন লোকাল রাস্তার কাছে সেখানে ওদের লোক থাকে ওই লোকই মধ্য স্বত্বদের কাছে বিক্রি করেন এবং তারাই মূলত ফোনের মাধ্যমে অর্ডার নেন এবং তাদের কাছে বিক্রি করেন।

গোপালগঞ্জ অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাংবাদিক জয় বলেন, শুধু যে পানকৌড়ি, বালি হাঁস, বক পাখি শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ছে তা নয়। শীতের আগমনে এ অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে আশ্রয় নেওয়া নানা প্রজাতির অতিথি পাখি শিকার করছে এক শ্রেণির স্বার্থন্বেসী মহল। বছরের পর বছর ধরে এসব পন্থায় বক শিকার করে বাজারে বিক্রি হলেও পাখি শিকার রোধে কার্যত কোন আইনী ব্যবস্থার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। এতে ক্রমশ বাড়ছে পাখি শিকার। তাছাড়া পাখি শিকারে প্রশাসনের দুর্বল অভিযান ও নজরদারি না থাকায় এ বছর পাখির আগমন কমে গেছে। এতে নষ্ট হচ্ছে এ অঞ্চলের সৌন্দর্য। শিকারিদের হাত থেকে পাখি শিকার বন্ধ না করলে গোপালগঞ্জের বিলগুলোতে এক সময় কোন পাখির আগমন ঘটবে না বলে মনে করে তিনি।

একই সাথে পাখি শিকার বন্ধে আরো সচেতনতা বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

কোটালীপাড়া উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা এএসএম মাহফুজুর রহমান বলেন, পাখি আমাদের জীব বৈচিত্র রক্ষা করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এদের টিকিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব যারা পাখি শিকার করছে তাওেদর অতি দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।   

এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, পাখি শিকার রোধে আমরা এ বছর এখনো কোন অভিযান করি নাই। শুনেছি পাখি শিকার চলছে, হয়তো খুব শীঘ্রই পাখি শিকার বন্ধে অভিযান চালানো হবে।

Bootstrap Image Preview