Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার চিরচেনা খেজুর রস

ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধিঃ 
প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:৪৭ PM
আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০৩:৪৭ PM

bdmorning Image Preview


ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। বছরে একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে এদেশ। কালের পরিক্রমায় প্রতি বছরই হাজির হয় শীতকাল। সকালে ঘাসের ডগায় শিশির ভেজা মুক্তকণা জানান দিচ্ছে শীতের। বছরে এ সময় বিভিন্ন রকমের প্রকৃতিক উপাদান নিয়ে হাজির হয় এই ঋতু। তার মধ্যে অন্যতম খেজুর রস। কিন্তু নওগাঁর মহাদেবপুরে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার চিরচেনা খেজুর রস।

শীতের সাথে রয়েছে খেজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। শীত মৌসুমের শুরুতেই গ্রামগঞ্জের মানুষেরা খেজুর গাছ ছিলানো (কাটা) নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন, কে কার আগে রস সংগ্রহ করতে পারে। বিশেষ করে শীত মৌসুম এলে গাছিদের আনন্দের সীমা থাকত না। শীতের ভোরে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছিরা মহাব্যস্ত হয়ে পড়ত।

কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুঁলে ঝুলে রস সংগ্রহ করত গাছিরা। খেজুর রস সংগ্রহ করে নতুন আমন ধানের পিঠা, ভাপা, পুলি ও পায়েশ তৈরির ধুম পড়ে যেতো গ্রামে গ্রামে। তাছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ও মুড়ি খাওয়া প্রায় সর্বস্তরের মানুষের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠতো। শীত যতো বাড়তে থাকতো খেজুর রসের মিষ্টতাও ততো বাড়তো।

এক সময় খেজুর রসের মন মাতানো গন্ধে মৌ মৌ করত পল্লী গ্রামের অলি-গলি। শীতের সকালে খেজুর রসে ভিজিয়ে মুড়ি না খেলে গ্রামগঞ্জের মানুষদের যেন দিনটাই ভালভাবে শুরু হতনা। শীতের সকাল মানেই গ্রামের অলি-গলিতে চলত রস মুড়ির আড্ডা। সময় বয়ে চলার সাথে সাথে রস-মুড়ি খাওয়ার সকালের সেই পারিবারিক আড্ডা বর্তমানে আর দেখা যায় না।

কারণ হিসেবে জানা যায়, বাড়ি-ঘর নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে খেজুর গাছের সংখ্যা পল্লীগ্রামে অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। যে হারে গাছ কাটা হয়েছে সে হারে রোপন করা হয়নি। এছাড়া একশ্রেণির অসাধু ইটভাটা ব্যবসায়ী জ্বালানী হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে গাছের সংখ্যা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

যা আছে তাও সঠিকভাবে পরিচর্যা না করা এবং গাছ ছিলানোর (কাটা) পদ্ধতিগত ভুলের কারণে প্রতিবছর অসংখ্য খেজুর গাছ মারা যাচ্ছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও পেশাদার গাছির সংকট। তারপরেও উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ইতিমধ্যে শখের বশতঃ গাছিরা নামমাত্র রস সংগ্রহ করছে।  

উপজেলার কর্ণপুর গ্রামের গাছি কুদ্দুস জানান, শীত মৌসুম এলে গাছ ছাটাই করে রস বিক্রির টাকায় ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতাম। আগে প্রতিবছর শীত মৌসুমে নিজের গাছ ছাড়াও নির্ধারিত অর্থ বা গুড় দেওয়ার চুক্তিতে অন্যের ১০-১৫টি গাছ ছিলতাম (কাটা)। কিন্তু এখন গাছ মরে যাওয়া এবং গাছ বিক্রি করার কারণে মাত্র একটি গাছ কাটি। গাছ কম থাকায় গ্রামবাসী খেজুরের রস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

একই গ্রামের আছির আলী জানান, শীত মৌসুম এলেই সারা বছর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা খেজুর গাছের কদর বেড়ে যেত। আমার নিজস্ব খেজুর গাছ না থাকলেও আমি মালিকদের গাছ ছাটাই করে সংগ্রহীত রসের একটি অংশ প্রদান করতাম।

উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের কফিল উদ্দিন নামে এক প্রবীণ জানান, এক সময় আমাদের এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে, জমির আইলে, রাস্তার পার্শ্বে, পতিত জমিতে সারি সারি খেজুর গাছ ছিল। বর্তমানে খেজুর গাছ মরে যাওয়া এবং বিক্রি করার কারণে খেজুর গাছ নেই বল্লেই চলে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা কমতে কমতে বিলুপ্ত প্রায়। হয়ত সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন খেজুর রসের কথা মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্মের কাছে খেজুর রস রূপকথার গল্পের মত মনে হবে। তবে সচেতনরা মনে করছেন, বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পার্শ্বে, পরিত্যক্ত স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে খেজুর গাছ রোপন করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খেজুর গাছের রস ও গুড় সম্পর্কে কোন গল্পকথা বলতে হবে না।
 

Bootstrap Image Preview