সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন তথ্য প্রকাশ করেছেন সৌদি আরবের জ্যেষ্ঠ এক সরকারি কর্মকর্তা। রোববার রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরেই শ্বাসরোধ করে খাসোগিকে হত্যা করা হয়।
দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তাকে বোঝানো হচ্ছিল। কথা না শোনায় হত্যা করা হয়েছে।’ পরে লাশ এক তুর্কি সহযোগীর কাছে দিয়ে দেন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। এদিকে, একদিনের মাথায় ভোল পাল্টে ফেলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
চাপে পড়ে খাসোগি হত্যা নিয়ে সৌদির ব্যাখ্যাকে অসম্পূর্ণ বলেছেন তিনি। সৌদির ওপর চাপ আরও বাড়ছে। জড়িতদের বিচার দাবি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
রিয়াদের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। রয়টার্স বলেছে, ২ অক্টোবর রিয়াদ থেকে ১৫ কর্মকর্তাকে ইস্তাম্বুলে প্রেরণ, কিভাবে খাসোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হত্যার পর লাশ কোথায় পাঠানো হয় সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘খাসোগিকে হত্যার পর তার পোশাক পরেই কনস্যুলেট থেকে এক কর্মকর্তা বেরিয়ে যান। যাতে বোঝানো যায়, কাজ শেষে কনস্যুলেট থেকে খাসোগিই বেরিয়ে গেছেন।’ ৫৯ বছর বয়সী খাসোগির নিখোঁজের ২ সপ্তাহ পর্যন্ত চুপ ছিল সৌদি আরব।
শনিবার দেশটি স্বীকার করে যে, কনস্যুলেটে তর্ক-বিতর্ক থেকে মারামারিতে খাসোগি মারা গেছেন। তুরস্কের সরকারি কর্মকর্তাদের ধারণা, খাসোগির লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে।
কিন্তু সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, সাংবাদিক খাসোগিকে হত্যার পর তার মরদেহ একটি কম্বলে মুড়িয়ে ফেলা হয়। পরে লাশটি সরিয়ে ফেলার জন্য স্থানীয় এক তুর্কি কর্মচারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। লাশ বেলগ্রেড বনের কাছাকাছি কোথাও ফেলা হতে পারেও বলে জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু খাসোগিকে নির্যাতনের পর শিরশ্ছেদ করার অভিযোগ অস্বীকার করেন ওই কর্মকর্তা। খাসোগি হত্যায় সরকারের দেয়া তথ্য কেন বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক উৎস থেকে পাওয়া তথ্য ছিল মিথ্যা। যে কারণে তথ্য পরিবর্তিত হয়েছে। পরে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু হয়। এতেই এসব বেরিয়ে আসে। তদন্ত এখনও চলমান।’
সৌদি কর্মকর্তা আরও বলেন, ওয়াশিংটনে পাড়ি জমানো সৌদি রাজপরিবারের সাবেক এ উপদেষ্টাকে রিয়াদে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সরকার। তার ভাষ্য, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগের ১৫ সদস্যের দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠান সৌদির গোয়েন্দা উপ-প্রধান আহমেদ আসিরি। একটাই উদ্দেশ্য, খাসোগির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করা।
তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে খাসোগিকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে এ দলের প্রতি স্থায়ী আদেশ জারি ছিল। এ আদেশ বলে তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ১৫ সদস্যের ওই দল গঠন করেন আসিরি।
পরিকল্পনা করা হয়, ওই দল ইস্তাম্বুলের বাইরে একটি বাড়িতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাসোগিকে নিরাপদে আটকে রাখবে। যদি দেশে ফিরতে না চান তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সৌদির ওই কর্মকর্তা বলেন, শুরুতেই সব কিছু ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকে।
একপর্যায়ে এ কর্মকর্তারা আদেশ লঙ্ঘন করে সহিংস হয়ে উঠেন। খাসোগিকে কনস্যাল জেনারেলের কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখানে মাহের মুত্রেব নামের এক কর্মকর্তা তাকে সৌদি ফেরার আহ্বান জানান। খাসোগি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
একটু কৌশলী হয়ে খাসোগি বলেন, ‘বাইরে তার জন্য এক নারী অপেক্ষা করছেন। যদি আমি ১ ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট ভবন থেকে বের না হই, তাহলে তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ওই নারী।’
ওই নারী খাসোগির বাগদত্তা হাতিস সেনগিজ। রয়টার্সকে তিনি বলেন, কনস্যুলেটে প্রবেশের আগে দুটি মোবাইল ফোন খাসোগি তার হাতে দিয়ে যান। খাসোগি তাকে বলেন, ভেতর থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করি। বের হতে দেরি হলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের জ্যেষ্ঠ এক সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যও বলে যান।
সৌদি ওই কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, কনস্যাল অফিসে ফেরার পর মুত্রেবকে খাসোগি বলেন, তিনি কূটনৈতিক নীতি-নৈতিকতা লঙ্ঘন করছেন। আপনি আমার সঙ্গে কী করতে যাচ্ছেন। আপনি কী আমাকে অপহরণ করতে চান? জবাবে মুত্রেব বলেন, হ্যাঁ। আমরা তোমাকে ড্রাগ প্রয়োগ করব এবং তুলে নিয়ে যাব। এ ধরনের বাক-বিতণ্ডার মধ্যে ধস্তাধস্তি বেঁধে যায়।
খাসোগি চিৎকার শুরু করলে ভয়ের মধ্যে পড়ে যায় দলটি। মুখে কাপড় ঢুকিয়ে চিৎকার থামানোর চেষ্টা করলে শ্বাসরোধে মারা যান খাসোগি। কিন্তু আসলে তাকে হত্যার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
এদিকে, মুস্তফা মাদানি নামের এক কর্মকর্তা খাসোগির কাপড়, চশমা ও অ্যাপল ব্র্যান্ডের ঘড়ি পড়ে কনস্যুলেটের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। খাসোগি ওই ভবন থেকে বেরিয়ে গেছেন এমন গল্প সাজানোর প্রচেষ্টা থেকে মাদানিকে তার পোশাক পরানো হয়। ভবন থেকে বেরিয়ে মাদানি চলে যান সুলতানাহমেত জেলায়। সেখানে পৌঁছে তার পোশাক-সামগ্রী ফেলে চলে যান। পরে ওই দল সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে একটি মিথ্যা প্রতিবেদন পাঠায়।
সৌদির ‘টুইটার আর্মি’ নিয়োগ : নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, হত্যাকাণ্ডের শিকার খাসোগির ওপর নজরদারি চালিয়েছিল সৌদি আরব। এ কাজে নিয়োজিত ছিল একটি ট্রল ফার্ম। ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত তারা। নজরদারি প্রক্রিয়ায় জড়িত এ বাহিনীকে ‘টুইটার আর্মি’ আখ্যা দিয়েছে তারা।
সমালোচকদের হয়রানি করতে ২০১০ সালে সৌদি কর্তৃপক্ষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উপদেষ্টা সৌদ আল কাহতানি এ কৌশল তৈরি করেছিলেন। খাসোগির টুইটার অ্যাকাউন্টে নজরদারি চালাত ওই বাহিনী।
সৌদির ওপর চাপ বাড়ছে, সন্তুষ্ট নয় বিশ্ব : খাসোগি হত্যার ঘটনায় সৌদির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি বিশ্ব নেতারা। এ ঘটনায় সৌদির পক্ষে নমনীয় থাকা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেন, সৌদি আরবের স্বীকারোক্তি নিয়ে তিনি ‘সন্তুষ্ট’ নন। তিনি বলেন, ‘উত্তর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট নই। এ ঘটনায় সৌদির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু অস্ত্র চুক্তি বাতিল করলে তাতে সৌদি আরবের চেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতিই বেশি হতো।’ খাসোগি হত্যার ব্যাপারে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদের কিছু না জানার ‘সম্ভাবনা’ রয়েছে বলেও তিনি জানান। এ নিয়ে একদিনের মধ্যে ভোল পাল্টালেন ট্রাম্প। সৌদির স্বীকারোক্তির পর তিনি বলেছিলেন, ‘রিয়াদের এ স্বীকার বড় ভালো পদক্ষেপ। আমি সন্তুষ্ট।’
এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোঘেরিনি। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেল এ হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের ‘স্বচ্ছ তদন্ত’ দাবি করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস।
শনিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি স্পষ্ট না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই।’ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর এটাকে ভয়াবহ ঘটনা বলে বর্ণনা করেছে এবং এ হত্যার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানিয়েছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোঁ-ইভ ল্য দ্রিউ ঘটনার আরও তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেন, অনেক প্রশ্নের ‘এখনও উত্তর পাওয়া বাকি।’