Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

কেমন আছেন নদী পাড়ের নারী জেলেরা?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:৫৪ PM
আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:৫৪ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: প্রতিবেদক


গড়ইখালী। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে নদীতে মাছ শিকার করে। মাছ শিকারে পুরুষ জেলের পাশাপাশি দেখা যায় নারী জেলেদের। সেসব নারী জেলেদের কারও স্বামী আছে আবার কারও স্বামী নেই। কেউ কেউ স্বামীর সাথে মাছ শিকারে যায়। আবার অনেক নারী স্বামীকে হারিয়ে সংসারটা দাঁড় করানোর জন্য জাল হাতে নদীতে নেমে পড়েন মাছ শিকারে।

কখনো দুর্যোগের হানা, কখনো দস্যুদের অত্যাচার। এর ওপর দরিদ্রতা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে। এসবের বোঝা নারীর ওপরে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষ মানুষটিকে হারিয়ে নারীর জীবন যুদ্ধটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

সন্তান লালন-পালনের সঙ্গে সংসার চালানোর পুরো দায়িত্বটাই পড়ে নারীর ওপর। এ সবের ভেতর দিয়ে নারীরা এগোয় সমানতালে। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার। বিপন্ন নারীরাও এগিয়ে যান স্বপ্ন পূরণের দিকে। গড়ইখালী গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে আত্মপ্রত্যয়ী বহু নারীর সন্ধান পাওয়া যায়।

জানা যায় ওই গ্রামের আবাসন প্রকল্পে পাওয়া বাড়িতে বাস করেন অনেক জেলে নারী।

পাইকগাছার গড়ইখালীর ইউনিয়নের আবাসনের বাসিন্দা হাসিনা বেগম। তিনি তুলে ধরেন তার জীবনের হাজারো সমস্যার কথা। এই দুর্গম জনপদে নারীদের নিগ্রহের চিত্র ফুটে ওঠে তার সাথে আলাপ চারিতার মাধ্যমে।

জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই তাদের। একদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব থেকে ঘরবাড়িকে রক্ষা করার সংগ্রাম অন্যদিকে নিজেকে এবং নিজের সংসার টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম।

তিনি বলেন, একেকটা দিন যায় আর চিন্তার পাহাড় এসে পড়ে মাথার উপর। কখনো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি না। মনে হয় এই বুঝি নদীর জোয়ার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এইদিকে ঘরের উপরে চাল নেই সেই সাথে আছে খাদ্য সংকট। সরকারী আবাসনে পাওয়া ঘরে চাল নেই প্রায় ৩ বছর ধরে। বৃষ্টি হলে ভিজতে হয়। কিন্তু এদিকে যদি চাল ঠিক করতে যায় তাহলে পেটে দানা দেয়ার মত কোনো অর্থ হাতে থাকে না।

তিনি আরও বলেন, এত অভাবে থাকি তবুও হাত পাতি না কারও কাছে কিন্তু আমি সরকারের কাছে ভিজিএফ কার্ড চাই। এখানকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আমাদের দিকে ফিরেও তাকান না। আবাসনের কোনো উন্নয়নও করেন না। যার পরিণতিতে আজ আমাদের ঘর আছে কিন্তু ঘরের চাল নেই। তাই আমি যদি ভিজিএফ কার্ড পাই তাহলে আমার পেটে ভাত দেয়ার জন্য চিন্তা করতে হবে না।

নারী হয়ে নদীতে মাছ ধরায় অনেক সময় মানুষ নানা রকম বাজে কথা বলে। তখন খুব কষ্ট হয়। কিন্তু তখন নিজ মনকে বুঝ দেয় যে আমার স্বামী অসুস্থ আমি যদি মাছ ধরি তাহলে তার উপর থেকে এই চাপ একটু হলেও কমবে।

আরেক নারী জেলে সাজেদা খাতুন। তিনি ২০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরেন। স্বামী পরিত্যাক্ত সাজেদা এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এখন নিজে নিজেই টিকে আছেন জীবন সংগ্রামে।

তাঁর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, স্বামী আমাকে ত্যাগ করার পর আমার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। প্রতিটা পদে পদে আমি অবহেলিত হয়েছি। না যেতে পেরেছিলাম নিজের বাবার বাড়ি না অন্য কোথাও। বাবার বাড়িতে যদি যেতাম তাহলে সেটা তাদের উপর বোঝা হয়ে যেত কারণ বাবার বাড়ির অবস্থাও খারাপ।

এদিকে এক মেয়ে আমার কোলে। তার মুখের দিকে চেয়ে আমি নেমে পড়ি নদীতে কারণ আর কেউ না হোক মেয়ের জন্য জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে  হবে। এরপর গত ২০ বছর আমি নদীতে মাছ মেরে বেড়াই। এখন আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আমি একাই পার করতেছি আমার জীবন।

তিনি আরও বলেন, নদীতে সবসময় মাছ পাওয়া যায় না। এই সময় আমরা পড়ি বিপদে।  আমরা না পায় কোন সরকারী সুযোগ সুবিধা, না পায় কোনো কাজ। গত ৩ বছর ধরে আবাসনে কোনো কাজ হয়না। ঘরের চাল নাই, পায়খানার সু-ব্যবস্থা নাই, নদীর জোয়ার হলেই ডুবে যায় এই আবাসন। কিন্তু তারপরেও টনক নড়ে না এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের।

সাজেদা খাতুনের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে শুরু হয় বৃষ্টি। তখন দেখা যায় তাদের নিজেদের সম্পদ রক্ষা করার করুন দৃশ্য। কেউ ছাগলকে কোলে করে নিয়ে শুকনো জায়গায় নিয়ে আসছে, কেউ ঘরে যেন পানি না পড়ে সেটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

বৃষ্টি কমলে দেখা যায় আসমা বেগম নামের এক নারী তার ঘর থেকে বৃষ্টির পানি সরানোর কাজে ব্যস্ত।

তার সাথে বলতে গেলে তিনি জানান, দারিদ্র আমাদের পিছু ছাড়ে না। গত ৭ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরেন তিনি। তার স্বামী এলাকায় ফেরী করে চা বিক্রি করে। তিনি ও তার স্বামীসহ পরিবারে ৫ জন বসবাস করেন। কিন্তু দারিদ্রতার কারণে থমকে যাচ্ছে তাদের জীবন। না পারছে সন্তানদের মৌলিক চাহিদা পুরণ করতে না পারছে সংসার টিকিয়ে রাখতে। এরপর আবার নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি।

এসময় চোখের জল মুছতে মুছতে আসমা বেগম বলেন, জীবনে কত কষ্ট করেছি, সে কথা বলে শেষ করতে পারব না। ছেলেদের লেখাপড়া করাতে পারছি না। স্বামী ফেরী করে করে কিছু টাকা-পয়সা রোজগার করে। নিজেও মাছ ধরার পাশাপাশি অন্যের বাড়িতে কাজ করছি। কষ্ট হচ্ছে, তবুও জীবনযুদ্ধে হারতে চাই না।

দুর্যোগ-দুর্বিপাকে পড়া নারী জেলেরা বা স্বামী হারা নারী জেলেরা অনেক সমস্যায় পড়েন। পরিবারের বোঝা চাপে নারীর কাঁধে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পান না তেমন কোনো সহযোগিতা।

এ বিষয়ে গড়ইখালী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য জোয়াদ্দার মিজানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, সরকার অনুদান ঠিকই দেয় কিন্তু তার বেশির ভাগ চেয়ারম্যানের দখলে। পাওয়া যায় না সেসব অনুদানের হিসাব। এছাড়া ভিজিএফ কার্ড প্রদানের ক্ষেত্রেও দেখা যায় অনিয়ম। ফলে ভুক্তভুগি হয় এই নারী জেলেরা।

এটা তো গেলো খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গড়ইখালী নামক গ্রামের নারী জেলেদের করুণ জীবন যাপনের চিত্র। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলে বসবাসকৃত সকল নারী জেলেদের জীবনে রয়েছে ভয়ানক অনেক কাহিনী। যে কাহিনীতে তারা ভেঙ্গে পড়েন না বরং পেয়েছেন জীবন সংগ্রামে সংগ্রাম করার শক্তি।

খুলনা ছাড়াও বরগুনায় জেলার ৬ উপজেলার পায়রা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকায় তালিকাভূক্ত কার্ডধারী ৪৫ হাজার ৬২১ জন জেলের বাস। এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ হাজার জেলেবধূ সরাসরি মাছ ধরার কাজে শ্রম দেন। পরিবারের অন্য নারীদেরও সবাই কমবেশি মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণনসহ নানা কাজে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ শ্রমজীবী নারী।

এর উপর রয়েছে হয়রানি। নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কোলের বাচ্চা থাকলে তাদের কাজে নেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কুপ্রস্তাব দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবুও সংসারের প্রয়োজনে নারী শ্রমিকরা এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দিনরাত কাজ করে চলেছেন আর স্বপ্ন দেখছেন একটা সুন্দর জীবনের।

Bootstrap Image Preview