Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৬ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

কবে আমাদের কাছ থেকে দুটি গ্লাস নিরাপদ হবে?

ইন্ডিয়ার ডায়েরি

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:২১ PM
আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:২৮ PM

bdmorning Image Preview


সরোজ মেহেদী।।

'বিমানবন্দর' শেষ দেখা হয়েছিল মাস ছয়েক আগে। সাড়ে তিন বছর পর তুর্কি দেশ থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার দিন। মাতৃভূমিতে ফেরার যে ব্যাকুলতা সে সময় টের পাচ্ছিলাম তার কাছে জীর্ণশীর্ণ ঢাকা আর তার যানজট তুচ্ছ মনে হতো। এ জন্য আমি বলি, বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষকে অন্তত এক বছর বিদেশে থেকে আসা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিদেশের নিঃসঙ্গ জীবন তাকে যেমন দেশকে অনুভব করতে, ভালোবাসতে শেখাবে। আবার শেখাবে জীবন, নগর জীবনের শৃঙ্খলাও।

বিদেশে না গেলে বোঝা যাবে না, দেশ কতটা আপন। স্বদেশির সঙ্গে দেশি ভাষায় কথা বলার মোহময় আনন্দ। একটা মানুষের জন্য একখণ্ড মাটি তথা পরিচয় কতটা জরুরি। ফিলিস্তিনি, কুর্দি বা কাশ্মীরিদের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, একখণ্ড মাটি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা কত তীব্র আর দীর্ঘ হয়। কতটা হাহাকার আর বিষাদ নিয়ে একেকটা সকাল আসে জেরুজালেমের আরব সাগরের তীরে। পরাধীনতার বিষবাষ্পে হাসতে হাসতেই কাঁদতে হয় তাদের।

বিদেশফেরত বাঙালিদের অভিযোগটা বেশ পুরনো, বিদেশের সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখে, গর্জিয়াস আর আধুনিক বিমানবন্দর থেকে দেশের বিমানবন্দরে নামার পর মন খারাপ হয়ে যায়। সঙ্গে কোনো বিদেশি বন্ধু থাকলে তাকে বলতে লজ্জ্বা হয় এটাই আমাদের বিমানবন্দর। এটাই আমার দেশ। একটা দেশকে আরেকটা দেশের মানুষ প্রাথমিকভাবে চেনে তার দেশের বিমানবন্দর আর সমুদ্রবন্দর দিয়ে। আমাদের এ দুটোর অবস্থাই বেহাল। সমুদ্রবন্দরের অবস্থা করুণ।

যাহোক, দেশে ফেরার ছয় মাসের মাথায় আবার বিদেশ যাচ্ছি। এবার অবশ্যই নিজেরই সাবেক দেশে, নিজেরই শহরে! গন্তব্য দিল্লি। আমার বাবা জন্মসূত্রে একজন ভারতীয়। ৪৭ এ পাকিস্তানি আর ৭১ এ বাংলাদেশি হোন। দুনিয়ার নানা দেশ ঘুরলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে এটাই আমার প্রথম ভ্রমণ! এ যেন দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের ওপরে/একটি শিশিরবিন্দু।

নয়াদিল্লি যাচ্ছি মহাত্মা গান্ধী আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে। সেখানে স্পিকার হিসেবে পেপার উপস্থাপন করব। উন্নয়নের এই শহর ঢাকায় যানজট সময়ে মাপা যায় না। তাই আগেভাগেই চলে যাই বিমানবন্দরে। হাতে সময় আছে, সময় কাটাতে আশপাশ ঘুরে দেখি। বেশ কয়েক বছর আগে প্রথমবার যেদিন দেশ ছাড়ি, সেদিন এয়ারপোর্টে এসে নিজেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যত্রতত্র ময়লার ছড়াছড়ি, সবকিছুতেই অপরিচ্ছন্নতা, অব্যবস্থাপনা। মাইগ্রেশন অফিসারদের আচরণ ছিল আরও বাজে। আজ মনে হলো কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। ভেতরে বসার জায়গাগুলো মেরামত করা হয়েছে। টয়লেটগুলো পরিষ্কার। কয়েকজন ক্লিনারকে দেখলাম, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খোশগল্প করতে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, টয়লেটগুলো বেশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে, কবে থেকে এমনটা হচ্ছে। বলল, হচ্ছে বেশ আগে থেকেই। তবে ইদানীং খুব বেশি হচ্ছে। তারা জানায় এ পাশের টয়লেটগুলো আগের মতোই আছে। তবে অপর পাশেরগুলোর আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

প্রথমবার যখন তুরস্ক সরকারের বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাই। তখন ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষার্থীর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল। ইমিগ্রেশন অফিসার অযথা দেরি করাচ্ছিলেন। ছাত্ররা রেগে গেলে হট্টগোল বাধে। পরে আরেকজনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আজ যে ইমিগ্রেশনে আমি দাঁড়ালাম তার অফিসারকে শান্ত ও স্থির মনে হলো। আমাকে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। কবে ফিরব ইত্যাদি। আমি উত্তর দিয়ে অপেক্ষা করলাম। তিনি আমাকে পাসপোর্টটা দিলে জানতে চাইলাম, আমি কি এখন যেতে পারি। হাসি দিয়ে বললেন যান। বাইরে আসার পর আরেকজন পুলিশ পাসপোর্টটা চেক করলেন। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম। কিছুক্ষণ পর আবার তার কাছেই জানতে চাইলাম, স্যার আমি মোবাইল চার্জ দেয়ার একটা জায়গা খুঁজছি, আপনি কি একটু সাহায্য করতে পারনে। তিনি জায়গা দেখিয়ে দিলেন। আমি সেখানেই বসেই আমার 'ইন্ডিয়ার ডায়েরি' লেখা শুরু করলাম। আশপাশের মানুষগুলো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বাঙালির কৌতূহল বলে কথা।

ভালোই ভালোই ইমিগ্রেশন শেষ হলো। অফিসার কিছুটা স্লো ছিলেন। কিন্তু আচরণ ভালো ছিল। যা এর আগে পাইনি। তবে এ কথা বলতেই হয়, মানুষকে সম্বোধনের একটা ভদ্রোচিত উপায় এখনো আমরা আমার সংস্কৃতির অংশ করতে পারিনি। যা ইউরোপিয়ানরা পেরেছে। এমনকি আরবরাও। ইন্ডিয়ান বা নেপালিরাও। হয়তো ভবিষ্যতে কোনো পুলিশ অফিসার আমাকে দেখে- এই কই যান আপনি, এদিকে আসেন। চিৎকার না দিয়ে জানতে চাইবে, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? কোথায় যেতে চান আপনি স্যার! বিমানবন্দরে কর্মরত সবাই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবে।

আপাতত দাঁড়ি টানি। অপরপাশে গিয়ে দেখি বাথরুমগুলো আসলেই আধুনিক করা হয়েছে। বাথরুমের বাইরে পানি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে দেখে খুশিতে মনটা ভরে গেল। আবার মন খারাপও হলো, ভীষণ রকমের খারাপ। গ্লাসগুলো শিকল দিয়ে বাঁধা। আহারে বাঙালি, পেটে ঘি হজম হয় না। কবে আমাদের কাছ থেকে দুটি গ্লাস নিরাপদ হবে! ভাবি, এই দৃশ্য দেখে বিদেশিরা কী ভাববে! একটা গ্লাসকে নিরাপদ রাখার মতো সভ্য হতে বাঙালিকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে!

ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে ও পেছনে যারা তাদের প্রায় সবাই শ্রমিক। সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাচ্ছেন, দিনে দিনে জমা হওয়া দেনা শোধাবেন বলে, ছেলের মুখে নতুন জামা দেখে অপ্রকাশিত আনন্দে উল্লসিত হবেন। তাদের দেখে কত মুখ চোখে ভাসে। জীর্ণশীর্ণ শরীরী এই মানুষগুলোর চোখেমুখে উত্তেজনা। একজন কর্মকর্তা সবার পাসপোর্ট চেক করে নম্বর অনুযায়ী ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দিচ্ছেন। মাঝবয়সী এ ভদ্রলোক সবাইকে তুমি তুমি করছেন, বয়সে তার চেয়ে বড় হবে এমন অনেককে ধমকাচ্ছেনও। আমি খানিকটা বিষাদ নিয়ে তার সামনে যাই। আমাকে পাসপোর্ট চেক না করেই বললেন, ওই লাইনে দাঁড়ান। আমি থামি, তার দিকে তাকাই। খুব আস্তে করে বলি, স্যার আমরা কি সবাই সবাইকে আপনি করে বলতে পারি না! তিনি বুঝলেন কি বুঝলেন না, জানি না। আমাকে আঙুল দিয়ে আবার কাউন্টারটা দেখিয়ে দিলেন।

একটু পর বিমানে চড়ে বসব। কলকাতা হয়ে যাব দিল্লি, নিউ দিল্লি। এই সেই কলকাতা। যেটা হতে পারত আমারও শহর। একটা সময় এই শহরটা ছিল আজকের ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের রাজধানী। এই শহর আজ যা বুঝত পুরো ভারত নাকি একদিন পর তা বুঝত। তাই এ শহর নিয়ে ছিল বেনিয়া দখলদার ব্রিটিশদের যত ভয়। থাক, এত কথা বাদ দেন। আসেন আপাতত অঞ্জন দত্তের একটা গান শুনি,

সেই পৃথিবীতে বাঁচবো বলে যুদ্ধ করি রোজ/একটুখানি বাঁচার জন্য হাজার আপস/সেই পৃথিবীর নাম কলকাতা কী ভারত জানি না/শুধু আমার লড়াই থামে না।

নোট: গানের তিনটা লাইন অঞ্জন দত্তের আর শেষেরটা আমার যোগ করা।

লেখক: তুর্কি স্কলারশিপ ফেলো। শিক্ষক, ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণবিশ্ববিদ্যালয়।

Bootstrap Image Preview