Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

তাইওয়ানের রুই বিনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সাথে ৯ দিন

আফলাতুন কাইসার জিলানী
প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:৩৮ PM
আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:৩৮ PM

bdmorning Image Preview


"আমার ছবি আঁকতে ভীষণ ভাল লাগে। বড় হয়ে আমি চিত্রশিল্পী হতে চাই। কিন্তু চিত্রশিল্পী হয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করা যাবে না। এ কারণে আমি আমার স্বপ্ন নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন"।

রুই বিন ক্যাম্পের শিশুরা প্রতিদিন তাদের অনুশীলন খাতায় নিজের অনুভূতি লিখত। আমার কো-মেন্টর এবং বন্ধু হাউ হাউ যখন আমাকে রুই বিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিশুর অনুভূতিগুলো এভাবেই চাইনিজ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে শুনাচ্ছিল তখন আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম একটা শিশুর চিন্তা কীভাবে এত গভীর হতে পারে?
গত আগস্ট মাসের ১৭ থেকে ২৫ তারিখ তাওয়ানের রুই বিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি আমার জীবনের অসাধারণ নয় দিন কাটিয়েছি সুবিধাবঞ্ছিত শিশু এবং তাদের জন্য আদর্শ হিসেবে ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী তাইওয়ানিজ এবং কোরিয়ান শিক্ষার্থীদের সাথে।

তাইওয়ানের রুই বিনে অবস্থিত রুই বিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর কাছে তাইওয়ান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি অব আর্টসের সহযোগী অধ্যাপক আর্নি কো এবং জাপানের তামা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আইগুল কুলনাজারোভা ২০১২ রুই বিন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন।

এবার ১৪তম বারের মত অনুষ্ঠিত হল রুই বিন ক্যাম্প।

বাংলাদেশ থেকে ২ জন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৪ জন, তাইওয়ানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে প্রায় ৪০জন শিক্ষার্থী এবারের ক্যাম্পে শিশুদের জন্য মেন্টর হিসেবে অংশগ্রহণ করে।

ট্র‍্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করা সংগঠন ইয়ুথ ইংগেজমেন্ট এন্ড সাপোর্ট(ইয়েস) এর প্রতিনিধি হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উর্মি ঘোষ অংশগ্রহণ করি।   

আমরা তাইওয়ান গিয়ে পৌঁছাই ১৫ আগস্ট। ১৬ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং তাইওয়ানিজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান। তাইওয়ানিজ ও কোরিয়ান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হই এবং আমরা তাদের কাছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করি।

১৭ আগস্ট থেকে শুরু হয় ক্যাম্পয়। এবারের ক্যাম্পের বিষয়বস্তু ছিল 'সহমর্মিতা'। শিশুদের মনে সহমর্মিতা জাগ্রত করার জন্য ছিল বিভিন্ন এক্টিভিটি এবং লেকচার। আমরা আমাদের লেকচারে শিশুদের সামনে বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে সহমর্মিতাকে উপস্থাপন করেছি। রবীন্দ্রনাথের 'ফুলে ফুলে ঢ'লে' গানের চাইনিজ ভার্সন তারা যখন আমাদের সাথে অনেক আগ্রহ নিয়ে গাচ্ছিত তখন ভীষণ ভালো লাগায় মন ভরে গিয়েছিল। ক্যাম্পের ষষ্ঠদিন ছিল শিশুদের জন্য ফিল্ড ট্রিপ। ওইদিন তাইওয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স সার্ভিসেস রুই বিন শিশু এবং ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী মেন্টরদের জন্য হোভার বেস ক্যাম্পে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাইওয়ান সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর বিভিন্ন সরঞ্জামাদির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয় আমাদের। সেদিন ক্যাম্পের শিশু এবং মেন্টরদের সাথে দেখা করতে আসেন পেরুর লিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ট্র‍্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক চেয়ারপার্সন জোস উগাজ, দক্ষিণ কোয়িরার ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ট্র‍্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক চেয়ারপার্সন জিও সাং কিম এবং ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি অব আর্টসের শিক্ষক এবং ট্র‍্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও রুই বিন আর্ট এন্ড ক্যারেক্টার ক্যাম্পের সহপ্রতিষ্ঠাতা আর্নি কো।

ক্যাম্পের সর্বশেষ দিন আমার জন্য নির্ধারিত অনুভূতি লেখার কাগজে একজন শিশু চাইনিজ ভাষায় লিখেছিল, "আমাদের শিক্ষা সফরের দিন আপনি আমার পাশে বসেছিলেন। আমার খুব ইচ্ছে করছিল আপনার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে। কিন্তু আমি ইংরেজি বাংলা কোনটাই বলতে পারি না তাই আর অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারিনি।"

শিশুদের সাথে মুখের ভাষায় কথা বলে অনুভূতি প্রকাশ না করতে না পারলেও শুধু অঙ্গভঙ্গি দিয়ে ভাব-বিনিময় করে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মাত্র এই অল্প কয়েকদিনে।

২৬ আগস্ট থেকে ২৮ আগস্ট সুযোগ হয়েছিল তাইওয়ানিজ এবং কোরিয়ান বন্ধুদের সাথে তাইওয়ানের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ এবং তাইওয়ানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার।

পরিচ্ছন্ন এবং পরিকল্পিত তাইপে নগরী দেখলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড় আর সমুদ্র দেখে আপনার মনে হবে পুরো তাইপেই বুঝি পর্যটন  নগরী। হরেক রকমের স্ট্রিট ফুড এখানকার রাস্তাগুলোর একটা বিশেষত্ব। তাইপে নগরীতে হাঁটার সময় আমি বারবার ভেবেছি একটু চেষ্টা করলে আমরা হয়ত ঢাকাকে এরকম অসাধারণ ভাবে গড়ে তুলতে পারি। আমরা গিয়েছিলাম একসময়কার স্বর্ণের জন্য বিখ্যাত স্থান ঐতিহাসিক জিওফেনে। জিওফেনের  অধিকাংশ স্থান দেখে  আপনার মনে হবে আপনি জাপানের কোন গ্রামে আছেন। এখানকার গেট, বাড়ীঘর, রেললাইন সবই জাপানের আদলে তৈরি করা। এর কারণ এখানে একসময় জাপানের উপনিবেশ ছিল।

তাইওয়ানের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার নাইট মার্কেটগুলো। এখানকার মন্দিরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নাইট মার্কেট। সন্ধ্যা নামলে নানা রকম খাবার আর দরকারী সব জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে জমজমাট হয়ে উঠে নাইট মার্কেটগুলো।

ভ্রমণের শেষদিন আমাদের সু্যোগ হয়েছিল একসময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দালান তাইপে ১০১ ভ্রমণের।

একজন বিখ্যাত ভ্রমণ লেখক লিখেছিলেন, তাইওয়ানের সবচেয়ে সুন্দয় বিষয় হচ্ছে তাইওয়ানিজ মানুষ। তাইওয়ানিজদের অন্যকে সাহায্য করার মনোভাব, সততা এবং শৃঙ্খলাবোধ কল্পনাতীত।

২৯ আগস্ট আমাদের এবং কোরিয়ান বন্ধুদের বিদায় দেয়ার জন্য তাইওয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসেছিল তাইওয়ানিজ বন্ধুরা। কেউ আমাদের জন্য বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল, কেউবা নিয়ে এসেছিল বিশেষ কোন উপহার। আমাদের বিদায়ে ওদের চোখেমুখে ছিল ভীষণ শূন্যতা। বিদায় বেলায় বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাইওয়ানিজ এবং কোরিয়ান বন্ধুরা সবাই একসাথে গাওয়া শুরু করে রবীন্দ্রনাথের 'ফুলে ফুলে ঢ'লে' গানের চাইনিজ ভার্সন- "হোয়ার হোয়ার মাউন্টেন..."।

আমার প্রতি অনুভূতি লেখার কাগজে বেশিরভাগ শিশুই চাইনিজে লিখেছিল, "আশা করি পরের ক্যাম্পে আপনি আবার আসবেন"।

আবার রুই বিন ক্যাম্পে যাব কিনা জানি না তবে তাইওয়ানিজ শিশুদের সাথে এবং তাইওয়ানিজ ও কোরিয়ান বন্ধুদের সাথে কাটানো অসাধারণ দিনগুলো সারাজীবনের জন্য স্মৃতি হয়ে থাকবে। আর তাইওয়ানিজ মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সহমর্মিতা, সেবাপরায়ণতার শিক্ষা জীবন চলার পাথেয় হয়ে থাকবে।

Bootstrap Image Preview