Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

যেভাবে চলছে কাকরাইল মসজিদ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:০৫ PM
আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:০৫ PM

bdmorning Image Preview
ফাইল ছবি


তাবলিগ জামাতের চলমান সংকটের কথা এখন আর গোপন কিছু নয়। দিল্লির নিজামুদ্দিনের তাবলিগি মারকাজের মুরব্বি মাওলানা সাদ-এর কিছু বিতর্কিত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ সংকট তৈরি হয়েছে।সংকটের আরেকটি কারণ হচ্ছে নিজেকে নিজেই বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির ঘোষণা করা ।কিন্তু পাক-ভারত-বাংলাদেশের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তির বিষয়টির ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন।তারা বারবার তাকে বক্তব্য প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছেন এবং তাকে নানাভাবে সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা উপেক্ষা করে আপন মতের উপর তিনি অটল রয়েছেন। উলামায়ে কেরাম মনে করেন, এমন বিশ্বাস পোষণাকারীর জন্য তওবা করা আবশ্যক। তওবা না করা পর্যন্ত তার নেতৃত্ব মান্য করার কোনো সুযোগ নেই। উভয়পক্ষের অনঢ় অবস্থানের কারণে একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। খবর  ইসলাম টাইমস

তাবলিগের চলমান সংকটের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মারকাজ কাকরাইল থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত তার এ বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বত্র ব্যাহত হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ ও কাকরাইল মারকাজের ওপর চলমান এ বিরোধের প্রভাব কতোটা প্রকট তা জানতে প্রতিবেদক গত ৮ অক্টোবর গিয়েছিলেন কাকরাইল মারকাজে। বিবাদমান উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তুলে ধরেছেন সেখানের সর্বশেষ পরিস্থিতি।

কোথায় যাবেন?

৮ অক্টোবর ২০১৮ সোমবার। দুপুর ১টা ২৫ মিনিট। কাকরাইল মসজিদের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেটের বাইরে ও ভেতরে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা। প্রবেশ পথে পুলিশকে সাহায্য করছেন দুই মুসল্লি। গেট পেরুতেই গতিপথ রুখে দিলেন তারা।

-কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন?

-নামাজ … কথা শেষ করতে দিলেন না।

-নামাজের জন্য আশে-পাশে আরও অনেক মসজিদ আছে।

আমি জানালাম, নামাজের পর কাকরাইলের একজন প্রবীণ আলেম ও মাশওয়ারার সাথীর ছেলের সাথে দেখা করবো। তিনিও আলেম এবং কাকরাইলের মুকিম। কথার ফাঁকেই পাশ থেকে কর্তব্যরত পুলিশ উঠে এলেন।

-তাকে ফোন দিন!

-দিয়েছি। নামাজের সময়। হয়তো এজন্য ফোন ধরছেন না। এক দৃষ্টিতে আমার চোখ পড়ে নিলেন। আচ্ছা যান।

কাকরাইল মসজিদে তাবলিগের কাজ থেমে নেই

কাজ বেড়েছে দেশজুড়ে!

পুলিশের অনুমোদন নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মুসল্লিরা নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওজু করে আমিও একটি জামাতের সাথে বসলাম। এ জামাতটি পাবনা থেকে এক চিল্লার জন্য বের হয়েছিলো। চিল্লা শেষ করে এখন বাড়ি ফিরে যাবে। একজন সাথীর কাছে প্রশ্ন করলাম, চিল্লা শেষ করে আসলেন। তাবলিগের চলমান সংকটে কাজ বেড়েছে না কমেছে? সানওয়ার নামের এ ব্যক্তি আমাকে বললেন, দাওয়াতের কাজ আল্লাহর। আল্লাহ এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই যাই হোক না কেন কাজ কমবে না কখনো। আমরা কাজের ক্ষেত্রে কোনো বাধা পাই নি। বরং মনে হয়েছে, কাজ আগের তুলনায় বেড়েছে।

এ দলের আমির মাওলানা আমির হামজা। একই প্রশ্নের উত্তরে তিনি যা বললেন তাতে বোঝা যায় চলমান সংকটের কারণে তাবলিগের কাজে বেশ প্রভাব পড়েছে। তিনি সরাসরি তা স্বীকার না করে বললেন, সব সমস্যার সমাধান আল্লাহর হাতে। সমস্যা হলে আমাদের আল্লাহর দিকেই ফেরা উচিৎ। আল্লাহর দিকে ফিরলে সমাধান হবে আর মানুষের দিকে ফিরলে সমস্যা আরও বাড়বে। আল্লাহই সমস্যার সমাধন করে দিন।

এটা আমাদের ব্যথা, ব্যথা লুকিয়ে রাখতে হয়

প্রতিবেদক জোহরের নামাজের আগে ও পরে কাকরাইল মসজিদের বিভিন্ন নজমে (ব্যবস্থাপনায়) দায়িত্বরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন পাহারাদার, তাশকিলের সাথী, বয়স্ক সাথীরা। তাদের সবাই তাবলিগ জামাতের চলমান সংকটে কাকরাইলের দৈনন্দিন আমলে যে ছন্দপতন হয়েছে তা লুকানোর চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে লুকাতে চান নিজেকে।

প্রতিবেদক নতুন জামাতের ইস্তেকবালে (অভ্যর্থনায়) রয়েছেন এমন একজনকে জিজ্ঞেস করেন, এখন প্রতিদিন কি পরিমাণ নতুন জামাত আসছে? আগের চেয়ে কমেছে? উত্তরে বললেন, না কমে নি। এমনই থাকে সাধারণত। একটু থেমে বললেন, আল্লাহ যাকে কবুল করেন সেই আল্লাহর রাস্তায় মেহনতের জন্য বের হন। একটু এগিয়ে একজন মুরব্বি –যিনি ২০ বছর যাবত নিয়মিত কাকরাইল আসেন- তিনি বললেন, ভিন্ন কথা। জামাত আসা ও জামাত বের হওয়ার পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে।

মসজিদের গেটে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে বললাম, সবকিছু আগের মতো ঠিকঠাক আছে তো? মধ্যবয়সী লোকটি অবলীলায় বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ! তাকে যখন বৃদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম তখন একটু সংশোধনী এনে বললেন যতোটুকু কমেছে তা চোখে পড়ার মতো না।

মসজিদের পাহারায় থাকা লোকটির কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম, এখানের সবাই কেন প্রকৃত অবস্থা গোপন করতে চাইছেন? উত্তরে তিনি বললেন, এটা আমাদের ব্যথা, ব্যথা লুকিয়ে রাখতে হয়। আর নিজেদের পরিচয় গোপন করছেন কেন? ‘ঝামেলা আছে সেটা আপনি জেনেই এসেছেন। আমি যা বলবো তাতে কোনো পক্ষ অসন্তুষ্ট হলে হয়তো খেদমতের শেষ সুযোগটুকুও আমরা হারাবো।’ বললেন, পাহারাদার সাথী।

হয়তো এ কারণেই কোনো পক্ষের মুরব্বিরাই মিডিয়ার নাম শুনে কথা বলতে রাজি হননি। অনেক চেষ্টা করা পরও কথা বলেননি তারা। তাদের একটাই কথা এগুলো মিডিয়ায় বলার মতো বিষয় নয়। ফলে প্রতিবেদক কথা বলেন উভয়পক্ষের মধ্য সারির ব্যক্তিদের সাথে। এদের মধ্যে রয়েছেন, ইন্জিনিয়ার তানভির, মোহাম্মদ মিজান, মাওলানা আনাস, মাওলানা যাকারিয়া, মুফতি উসামা (কাকরাইল মাদরাসার শিক্ষক) ও মাওলানা মুশফিকুর রহমান।

দুই ভবনে দুই পক্ষ

কাকরাইল মসজিদের গেট পার হলেই মসজিদের দু’পাশে চোখে পড়বে দু’টি নির্মাণাধীন ভবন। এই দুই ভবনে অবস্থান নিয়েছেন তাবলিগ জামাতের বিবাদমান দুটি পক্ষ। ডানপাশের ভবনে থাকেন মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়েরসহ উলামায়ে কেরামের পক্ষাবলম্বনকারী মুরব্বিগণ। তারা সেখানে থেকেই পরিচালনা করেন তাবলিগের কার্যক্রম ও কাকরাইল মাদরাসা। বামপাশের ভবনে থাকেন মাওলানা সাদ-এর অনুসারী ইন্জিনিয়ার ওয়াসিফুল ইসলামসহ অন্য মুরব্বিরা। দুই ভবনে দুইপক্ষের সাধারণ চলাচল বন্ধ। সাধারণত কেউ কারো ভবনে যান না। ব্যতিক্রম শুধু মাওলানা মুহাম্মদ হোসাইন। তিনি উলামাদের পক্ষে অবস্থান নিলেও থাকেন বামপার্শ্বের ভবনের তৃতীয় তলায়। প্রবীণ এ আলেমের প্রতি উভয়পক্ষ সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল বলেই জানা গেলো একাধিক জনের সাথে কথা বলে।

যেভাবে চলছে কাকরাইল মসজিদ

তাবলিগের চলমান সংকট ঘণিভূত হওয়ার পর মাননীয় স্বরাষ্টমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ বৈঠক করেন দেশের শীর্ষ ৫ আলেমের সাথে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন উভয়পক্ষের তাবলিগি মুরব্বিরাও। সে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় রীতি অনুযায়ী কাকরাইল মসজিদ পরিচালিত হবে মাশওয়ারার (পরামর্শের) ভিত্তিতে। তবে দুই সপ্তাহ করে মাশওয়ারার ফায়সালা (সিদ্ধান্ত) দিবেন উভয়পক্ষের মুরব্বিরা। উপস্থিত থাকতে পারবেন উভয়পক্ষের মুরব্বি। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উভয়পক্ষ এখন দুই সপ্তাহ করে মাশওয়ারার ফায়সালা করছেন। তবে একপক্ষের ফায়সালার সময় অন্যপক্ষ একেবারেই অনুপস্থিত থাকেন। কোনো পক্ষই অপরপক্ষকে কাকরাইলের কোনো নজম বা আমলে অংশিদার করেন না।

বলা যায়, একপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় প্রত্যেকের মাশওয়ারার ফায়সালার সময়। এসময় একপক্ষ অপরপক্ষের লোকদের যাতায়াতের্ ‍উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ করেছে উভয়পক্ষ। অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে কাকরাইলে প্রবেশ করেন না অপরপক্ষের মুরব্বিরা।

এছাড়াও পারস্পরিক অভিযোগের কারণে উভয়পক্ষের দু’জন করে চারজন মুরব্বির কাকরাইলের কোনো ধরনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। তারা হলেন, মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের, সাইয়েদ ওয়াসিফুল ইসলাম।

বিবাদ সত্বেও চলছে দ্বীনের কাজ

দুই পক্ষের চোখে কাকরাইল

উভয়পক্ষের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম কেমন চলছে কাকরাইল মসজিদের কার্যক্রম। দাওয়াতি কাজে কোনো ছন্দপতন কি হয়েছে? উভয়পক্ষই বলেন, কাকরাইল মসজিদের কার্যক্রম তথা দাওয়াতি কাজে ছন্দপতন হয়েছে। তবে মাওলানা সাদ-এর অনুসারীগণ বিষয়টি যতোটা বড় আকারে দেখাতে চেষ্টা করেছেন উলামায়ে কেরাম তুলনামূলক স্বাভাবিক দাবি করেছেন কাকরাইলের পরিস্থিতি। তাদের বক্তব্যে কাকরাইলে বর্তমান চিত্র নিম্নরূপ,

শবগুজারি : কাকরাইল মসজিদের বড় একটি আমল বৃহস্পতিবারের শবগুজারি। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর শহরের তাবলিগি সাথীরা কাকরাইলে জড়ো হন এবং দীনের মেহনত সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বয়ান শুনেন। সকালে সবাই নিজ নিজ এলাকায়ে ফিরে যান।

উভয়পক্ষের দাবি শবগুজারিতে লোকের উপস্থিতি কমেছে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। তবে লোক হ্রাস পাওয়ার কারণ নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছ্ উভয়পক্ষের। মাওলানা সাদ-এর অনুসারীদের মতে চলমান সংকটে আস্থা হারিয়েছে সাধারণ সাথীরা, তাই তারা শবগুজারিতে আসেন না। অন্যদিকে উলামাপক্ষের সাথীদের দাবি মসজিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণেই শবগুজারির লোক কমে গেছে।

জামাত বের হওয়ার পরিমাণ : তাবলিগ জামাতের সাধারণ নিয়ম হলো কোনো এলাকা থেকে জামাত বের হলে তারা আগে কাকরাইল মসজিদে উপস্থিত হন। কাকরাইল থেকে তাদের রোখ (গন্তব্য) ঠিক করে দেয়া হয়। তাবলিগ জামাতের চলমান সংকট শুরু হওয়ার পর কাকরাইল মসজিদে জামাতবদ্ধ সাধারণ মুসল্লিদের আগমনের ধারা কমেছে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে উভয়পক্ষ বলেন, সাধারণ সাথীদের উপর মুরব্বিদের মতভিন্নতার খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। যতোটুকু তাদের কাজের গতিও খুব বেশি কমেনি। হিসেব করলে কাকরাইল থেকে জামাত বের হওয়ার পরিমাণ কমেছে মাত্র ২০%। এতোটুকু কম বেশ আগেও হয়েছে কখনো কখনো।

বিদেশিদের জামাত : এক সময় কাকরাইল মসজিদ ও তার আশেপাশে প্রচুর পরিমাণ বিদেশিদের দেখা যেতো। কিন্তু এবার কাকরাইল মসজিদ ঘুরেও বিদেশিদের চোখে পড়লো না। তাহলে কি বিদেশিদের আগমন কমে গেছে? নাকি বন্ধই হয়ে গেছে? খবর নিলাম দুই পক্ষের কাছেই। বর্তমানে কাকরাইলে বিদেশি জামাত উপস্থিতি নেই বললেই চলে জানালেন উভয়পক্ষ। কিন্তু আবারও কারণ ব্যাখ্যায় মতভিন্নতা পাওয়া গেলো এখানে। মাওলানা সাদ-এর অনুসারীদের মতে হজরতজির আনুগত্য থেকে সরে যাওয়াই কাকরাইলে বিদেশি জামাতের অনুপস্থিতির কারণ। হজরতজির ভালোবাসার কারণে তারা কাকরাইলে না এসে দিল্লিমুখী হয়েছে।

অন্যদিকে উলামায়ে কেরাম বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দাবি করলেন। তারা বললেন, বাংলাদেশে বিদেশি জামাত আসে মূলত ইজতেমার আগ দিয়ে। ইজতেমার আগে ডিসেম্বরে পাঁচ দিন ব্যাপী যে জোড় হয় তাতে তারা অংশগ্রহণ করে। ইজতেমা জোড় মিলে ১৫ দিনের মতো তারা বাংলাদেশ অবস্থান করে। এরপর কেউ জামাতবদ্ধ হয় আর কেউ দেশে ফিরে যায়। এ সময়টাতে বিদেশি জামাত সাধারণত বাংলাদেশে থাকে না।

মাদরাসা : কাকরাইল মসজিদ লাগোয়া মাদরাসায়ে উলুমে দ্বীনিয়া কাকরাইল মারকাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান। মাদরাসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে মারকাজ। মাদরাসায়ে ‍উলুমে দ্বীনিয়ার মোহতামিম মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের। তিনি উলামায়ে কেরামের পক্ষের মুরব্বি। শুধু তাই নয় তিনি কাকরাইল মাদরাসার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের মোহতামিম। তাবলিগের সংকট তৈরি হওয়ার পরও তিনি কাকরাইল মাদরাসা মোহতামিম পদে বহাল আছেন।

মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়েরের মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিপরীতপক্ষের কোনো আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, না। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। মাদরাসা কেমন চলছে জানতে চাইলে তারা বলেন, মাদরাসার কাজের সঙ্গে আমরা জড়িত না। তবে দূর থেকে মনে হয় ঠিক মতোই চলছে।

মাদরাসার একাধিক শিক্ষকের কাছে খোঁজ নিয়েও জানা গেলো মারকাজ থেকে তারা আগের মতোই সুযোগ-সহযোগিতা লাভ করছেন। মাদরাসার ছাত্রদের ভরণ-পোষণের খরচ, শিক্ষকদের বেতন সবকিছুই ঠিক মতো চলছে।

চলমান ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট নয় কোনো পক্ষ

সরকারের মধ্যস্থতায় বর্তমান ব্যবস্থাপনা চালু হওয়ায় উভয়পক্ষ তা মেনে নিয়েছেন বটে, তবে কোনো পক্ষই তাতে সন্তুষ্ট নয়। কারণ? কারণ হলো উভয়পক্ষই মনে করেন বিপরীত পক্ষের উপস্থিতি অনুচিৎ। মাওলানা সাদ-এর অনুসারীদের মতে বর্তমান ব্যবস্থাপনার কারণে এমন একটি দলের নেতৃত্ব স্বীকার করতে হচ্ছে যারা তাবলিগ জামাতের রীতি-নীতি ও ঐতিহ্য মানছে না।

আর উলামায়ে কেরামের মতে তারাও বর্তমান ব্যবস্থাপনার কারণে বাধ্য হচ্ছেন ভ্রান্ত চিন্তার অনুসারী একটি দলের সঙ্গে আপোষ করে চলতে।

দেশের দূর দূরান্ত থেকে আসছে ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ

উভয়পক্ষের দৃষ্টিতে সমাধান

মাওলানা সাদ-এর অনুসারী ও উলামায়ে কেরাম উভয়পক্ষই মনে করেন তাবলিগ জামাতের জন্য এখন একটি সংকটকাল চলছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনাও একটি আপাতকালীন ব্যবস্থা মাত্র। এ সংকটের আশু সমাধান চান তারা। তা কিভাবে? মাওলানা সাদ-এর অনুসারীদের নিকট সমাধান জানতে চাইলে তারা বলেন, তাবলিগ জামাত শত বছর ধরে যে নিয়মে চলেছে সে নিয়মে চললেই সমস্যার সমাধান হবে। তাহলো, নিজামুদ্দিনের আনুগত্য করা। নিজামুদ্দিনের আনুগত্য ব্যতীত এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই।

বিপরীতে উলামায়ে কেরাম বলেন, এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হলো মাওলানা সাদ-এর প্রত্যাবর্তন ও তওবা। আর তিনি তা না করলে বাংলাদেশের তার অনুসারীদের তার আনুগত্য ত্যাগ করতে হবে।

অর্থাৎ কোনো পক্ষই সমস্যার সমাধানে ছাড় দিতে রাজি নয়। কিন্তু কেন? মাওলানা সাদই বা কেনো নেতৃত্ব ছাড়ছেন না আর উলামায়ে কেরামই বা তাকে মানছেন না? উত্তরে মাওলানা সাদ-এর অনুসারীরা বললেন, দ্বীনের ব্যাপারে ছাড় দেয়াও জুলুম। হজরত উসমান রা. মৃত্যুর মুখেও খেলাফতের দায়িত্ব ত্যাগ করেননি। মাওলানা সাদ কেন তার দায়িত্ব ত্যাগ করবেন।

উলামাদের দাবি মাওলানা সাদ-এর ব্যাপারে আমাদের মূল আপত্তি তার নেতৃত্ব নিয়ে না। আমাদের আপত্তি তার ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারা। যা তার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যদি তার আপত্তিকর বক্তব্য থেকে সরে আসেন তাহলে আর কোনো বিরোধ থাকবে না।

উলামায়ে কেরাম তাদের বক্তব্যের উত্তরও দেন। তারা বলেন, হজরত উসমান রা. এর সঙ্গে তুলনা করাও এক ধরনের বিভ্রান্তি। কারণ, তাদের মর্যাদা ও অবস্থান কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হজরত উসমান রা.-এর ব্যাপারে যেসব অভিযোগ করা হয় তা ছিলো ভিত্তিহীন, কিন্তু মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। হজরত উসমান রা.-এর ব্যাপারে যারা অভিযোগ এনেছিলো তারা ছিলো সাধারণ মানুষ ও বিদ্রোহী। কিন্তু মাওলানা সাদ-এর ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন উলামায়ে কেরাম। সুতরাং উভয় ঘটনার মধ্যে অনেক পার্থক্য।

মাগরিবের নামাজ শেষে বের হলাম কাকরাইল মসজিদ থেকে। ততোক্ষণে খানিকটা ফাঁকা হয়েছে মসজিদ। নেমে আসা অন্ধকার যেন হাহাকার বাড়িয়ে দিচ্ছে কাকরাইল মসজিদের।

গেট পার হওয়ার সময় নতুন এক গাড়ি পুলিশ এসে অবস্থান নিয়েছে গেটের বামপাশে। রাতের বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তাদের আগমন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুলিশি পাহারা কতোটা মানানসই? কিন্তু তাদেরই বা কি দোষ। কোনো কেন্দ্রে বিরোধ হলে অপ্রীতিকর ঘটনা রোধ ও নিরাপত্তার জন্য তাদের ‍সহযোগিতা লাগবেই।

মসজিদ মুসলিম সমাজের প্রাণকেন্দ্র। অবমুক্ত পরিবেশে এখানের দ্বীনের চর্চা হওয়াই মসজিদের ইতিহাস, এটাই মসজিদের ঐতিহ্য। সেদিনটিরই প্রত্যাশা করে শান্তিপ্রিয় তাবলিগি ভাইয়েরা, আলেম-উলামা।

তারচেয়েও বড় প্রশ্ন বাংলাদেশের তাবলিগি কার্যক্রমের এই প্রাণকেন্দ্র কবে ফিরে পাবে তার ছন্দ, ফিরে পাবে তার গতি? সেসব ভ্রান্ত বিশ্বাস –যা বিশ্বব্যাপী দ্বীনি দাওয়াতের পরিবেশে বিপর্যয় ডেকে এনেছে- তার অবসান কোথায়? মানুষ কি এ বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারবে? নাকি তৈরি হবে নতুন ফেরকা। ভক্তি ও ভালোবাসার দামে বিক্রি হবে লাখো মানুষের বিশ্বাস।

সমাধান কখন হবে, কিভাবে হবে হয়তো আল্লাহ তায়ালায় ভালো জানেন। তাই মহান আল্লাহর কাছে বিনীত প্রার্থনাই এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ তিনি যেনো অন্ধ ভালোবাসা, অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর রাস্তার এসব পথিকদের উলামায়ে হকের দেখানো পথে পথচলার তাওফিক দেন। আমিন।

Bootstrap Image Preview