Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রাতের ভ্যানে ভর করে চলে তাদের ‘জীবনের চাকা’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০২:২৩ PM
আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৪:০১ PM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


কী রোদ, কী ঝড়-বৃষ্টি অথবা কনকনে শীতের রাত। কোন কিছুই যেন তাদের গায়েই লাগে না। যারা প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকার তাগিদে লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের কাছে এগুলোতো ঠুনকোই মনে হবে। জীবনের চাকা ঘুরানোর যে স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীতে এসেছিলেন তারা। সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। তবুও থেমে নেই তাদের জীবন যুদ্ধ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন-রাত ভ্যানের চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছেন তারা। স্বপ্ন ছিল হয়তো একদিন সুদিন ফিরবে। কিন্তু বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করলেও সুদিন ফেরেনি তাদের। এদেরই একজন ভ্যান চালক মামুন।

রাতের শেষভাগে যখন কর্মব্যস্ততায় মুখর হয়ে উঠছে রাজধানীর কারওয়ান বাজার। তখন বাজারের কোন ব্যস্ততায় যেন তাকে স্পর্শ করছে না। প্রতিদিনের মতো গ্যারেজ থেকে ভ্যান নিয়ে ধুয়ে মুছে এসেছেন কাজের সন্ধানে। তখন কোন কাজ না পেয়ে একাকী আনমনে ভ্যানের ওপর বসে অলস সময় পার করছেন মামুন।

সম্প্রতি রাত ৩ টার পরে রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। মামুনের মতো আরও অনেক ভ্যানচালক জীবিকার সন্ধানে প্রতিদিন গভীর রাতে ভ্যান নিয়ে আসেন এই বাজারে। কিন্তু আগের মতো কাজ না পেয়ে সকাল বেলা সামান্য অর্থ নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় তাদের।

মামুনের সাখে কথা বলে জানা যায়, জীবিকার তাগিদে ১২ বছর আগে রাজধানীতে এসেছিলেন তিনি। স্ত্রী সন্তান আর বাবা-মা থাকেন কিশোরগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে। প্রতিদিন গ্যারেজ থেকে ভ্যান ধুয়ে মুছে নিয়ে গভীর রাতে আসেন কারওয়ান বাজারে। এখানে কাঁচা বাজারের আড়তের তরকারী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে প্রতি রাতে ৫০০ টাকা বা বেশি আয় করে। সেটা দিয়েই নিজের খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা পাঠান পরিবারের জন্য। এভাবে ভালো দিন যাচ্ছিলো মামুনের। কিন্তু সম্প্রতি সেই আয়ে ভাটা পড়েছে। আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না তিনি।এ কারণে বাজার মুখর হয়ে উঠলেও কাজ না পেয়ে প্রায় সময় আনমনে ভ্যানের ওপর বসে কাজের অপেক্ষায় থাকেন।  অপেক্ষায় থাকেন আহারের সংস্থানের জন্য।

এখন এমনও রাত যায়, ১০০ টাকা নিয়েও সকালে ফিরতে হয় তার। এখন যেদিন ভালো হয় আয় সেদিন সর্ব্বোচ ৩০০ টাকা। এটা দিয়ে এখন তিনি নিজের খরচ মিটিয়ে পরিবারের জন্য পাঠাতে পারছেন না।

তবে জীবন যুদ্ধে চালিয়ে নিতে হাল ছাড়ছেন না তিনি। প্রতিদিনই কাজের পাওয়ার আশা নিয়ে কারওয়ান বাজার আসছেন। নিজের খরচ কমিয়ে বাবা-মা স্ত্রী সন্তানদের জন্য কিছু টাকা হলেও পাঠাতে পারছেন এটাই তার কাছে মানসিক প্রশান্তির।

মামুনের সাথে কথা বলে জানা গেল, আগে কারওয়ান বাজার ছিল জমজমাট।কিন্তু এখন যাত্রাবাড়ী, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বড় বাজার বেড়ে যাওয়ায় এখন কারওয়ান বাজারে আর আগের মতো কাজ পায় না মামুনের মতো এমন কয়েক’শ শ্রমিক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অন্যতম এই বাজারটিতে দুইভাবে ভ্যান চলে। একটি হলো ভ্যানচালক ইউনিয়নের অধীনে, যারা শুধুমাত্র এই বাজারেই চালাতে পারবে। যাদের  ভ্যানে চেইন থাকবে না শুধু ঠেলে ঠেলে চালাতে হবে। অন্যটি হলো বহিরাগত ভ্যানচালক যাদের চেইন থাকবে এবং ইউনিয়নের আওতাধীন থাকবে না। তারা বিভিন্ন গ্যারেজ থেকে আসে, তাদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মহাজন যারা তাদের দিক নির্দেশনা দেন।

অন্যদিকে কারওয়ানবাজার ভ্যানচালক ইউনিয়নের আওতাধীন প্রত্যেক চালককে প্রতিরাতে ১০ টাকা করে জমা দিতে হয়। যা থেকে তাদের দুর্ঘটনা অথবা অসুস্থজনিত কারণে টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া তাদের পারিবারিক বিষয়েও সহায়তা করে থাকে বলে জানা যায়।

সম্প্রতি বিডিমর্নিং টিম গভীর রাতে সরেজমিনে ঘুরে দেখতে পান, কারওয়ান বাজারে রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে ব্যস্ততা।সবাই নিজ নিজ কাজে বেশ মনযোগী কেউ বিক্রি করছে। কেউ কিনে নিচ্ছে পাইকারী দামে কিংবা কেউ দরদাম করে যাচ্ছেন। কিন্ত পাশেই মামুনের মতো একদল ভ্যানচালকদের অলস সময় পার করছেন।

কাজের জন্য অপেক্ষায় থাকা এসব ভ্যানচালকদের মধ্যে থেকে আবু তাহের বিডিমর্নিংকে বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি। কেউ কোনো মালামাল নিলে আমরা তা পৌঁছে দেই।

আক্ষেপ করে তিনি বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘আগের মতো কাম পাই না, টুকটাক করি আরকি। ভ্যানওয়ালাদের দিন ভালো না, বইয়া আছি মেলাক্ষন ধইরা। কি আর করুম বলেন। প্যাটের দায়ে করতাছি।’ আবু তাহেরের মতো অন্যরাও একই কথা জানালেন।

এসব ভ্যানচালকদের নিত্যদিনের কাজ নিয়ে মহাজন (মালিক) শাহজাহান বিডিমর্নিংকে বলেন, আমার তিনটা ভ্যান আছে এগুলো ভাড়া দেই, এরকম আরো মহাজন আছে। তাদের অনেকের ১০ থেকে ৩০/৪০টা পর্যন্ত ভ্যান আছে। কিন্ত আজকাল আর ভালো চলে না এই ব্যাবসা। আগে ব্যস্ত সময় গেলেও এখন অধিকাংশ সময় যায় বসে থাকে। তবুও কষ্ট করে চলছে এই ভ্যানচালকদের সংসার।

ভ্যানচালকদের নিয়ে জানতে কারওয়ানবাজার ভ্যানচালক ইউনিয়নের সভাপতি মো: খোকন খানের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার পরিবর্তে তার ছেলে মামুন খানকে পাওয়া যায়, তিনি বিডিমর্নিংকে বলেন, আমাদের এই ইউনিয়নের অধীনে বর্তমানে প্রায় ৫০০ ভ্যান আছে। তাদের নিয়ে প্রতি আড়াই বছর পর পর নতুন কমিটি করা হয়ে থাকে। যাতে করে তাদের যাবতীয় অভাব অনটনে সবাই একযোগে কাজ করতে পারি। আমরা এখন আগের তুলনায় কাজ কম পাই।

বিডিমর্নিং টিমের সদস্যরা কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখতে পান, রাত ১২টার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কারওয়ান বাজারে তরকারি বোঝাই ট্রাকগুলো একের পর এক আসতে শুরু করে। এসময় এসব ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর জন্যই প্রস্তুত থাকে কয়েক হাজার শ্রমিকসহ মামুন, তাহেরদের মতো ভ্যান চালকরা। আর গভীর রাতে আসতে শুরু করে রাজধানী ও এর আশে পাশের এলাকা থেকে পাইকারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় এসব ব্যবসায়ীরা নিজেদের ভ্যান, পিকআপ ভ্যান বা রিকশা দিয়ে কারওয়ান বাজার থেকে এসব তরকারি নিয়ে যায়। দিনের আলো ফোঁটার আগেই এসব তরকারি নিয়ে এসব পাইকারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ছুটেন নিজের এলাকায়। আর সারারাত কাঁচাবাজারে কাজ করা শ্রমিকসহ ভ্যানচালকরা সকালের খাবার খেয়ে কেউ এখানকার আড়তগুলোতে কেউবা নিজেদের বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেন। আর অপেক্ষায় থাকেন আবার কখন রাত হবে। কখন জমে উঠবে কারওয়ান বাজারের প্রতিদিনের ব্যস্ততা।

কারওয়ান  বাজার সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, কারওয়ান বাজার মূলত ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে। কারওয়ান সিং নামে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী প্রথমে একটি মার্কেট খোলেন। পরে তার নামেই পরিচিতি পায় এখনকার কারওয়ান বাজার। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে ঢাকা  সিটি করপোরেশন ক্ষুদ্র কাঁচাবাজারে আড়ত নামের একটি মার্কেট নিজেদের আওতায় নিয়ে আসেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত কারওয়ান বাজারের মোট আয়তন ৫০ একরেরও বেশি। এখানে অনেক আলাদা মার্কেট রয়েছে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট, সিটি করপোরেশন মার্কেট-১, সিটি করপোরেশন মার্কেট-২ বা সুপারমার্কেট ও কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচাবাজার আড়ত এ চারটি মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের আওতায় বেশকিছু টোল মার্কেট রয়েছে। আরও আছে সিটি করপোরেশনের আওতামুক্ত কিছু মার্কেট।

এ ছাড়া এই বাজার ঘিরে আরও রয়েছে বেশ কিছু ভাসমান মার্কেট। যেখানে চা-সিগারেট বা হালকা নাশতার জন্য খাদ্য-সামগ্রী বিক্রি হয়। এসব মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত প্রায় লাখ মানুষ। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয় এই মার্কেটে। যার বেশির ভাগই হলো কাঁচাবাজারকে কেন্দ্র করে।

রাজধানীতে দুমুঠে খাবারের জন্য যারা আসেন সেই মামুন-তাহেরদের জন্য এটা যেন কর্মক্ষেত্র। কারওয়ান বাজার তাদের কাছে তাই অনেকটা অন্নের বাজারের মতো। ভালো আয় হলে পরিবারের মুখে অন্নের সংস্থান হয়, না হলে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করতে হয়। কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন কর্মব্যস্ততা থাকলেও ভ্যানের চাকায় চলা তাদের জীবনযুদ্ধ কখনও থেমে থাকে না। কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন কর্মব্যস্ততা থাকলেও ভ্যানের চাকায় চলা তাদের জীবনযুদ্ধ কাজ না পেলে কখনও কখনও থেমে থাকে।

Bootstrap Image Preview