Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

আজমপুর টু আজিমপুর; ‘বিক্রি হওয়ার’ অপেক্ষায় তারা!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৬:৩১ AM
আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:৩৫ AM

bdmorning Image Preview
ছবি: বিডিমর্নিং


‘দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার টানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সভ্যতার প্রতি’ নামের বিখ্যাত কবিতায় এ কথা বলেছিলেন।

সময়ের সাথে সাথে অরণ্য বা গ্রামগুলো শহর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোন শহর গ্রাম হয়নি। প্রকৃতির খামখেয়ালীপনায় একদিকে যেমন নদীগর্ভে সবকিছু হারিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে শহরে ছুটেছেন মানুষ। অন্যদিকে উন্নত জীবনের আশায় গ্রামের সবকিছু বিক্রি করে অথবা গ্রাম ছেড়ে হয়েছেন শহরের বাসিন্দা। শহরমুখী এসব মানুষের কারণে দিন-রাত একাকার হয়ে ব্যস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা।

রাত গভীর হতে থাকলে যেমন নীরবতার চাঁদরে ঢেকে যায় পুরো শহর, তেমনি ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথেই মুখরিত হয়ে উঠে তিলোত্তমা ঢাকা। জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত ছুটে চলা এসব মানুষের সাথে মিশে আছে হর্ষ-বিষাদের গল্প আর টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করার অভিলাষ।

এখানে যেমন নিশ্চিত কর্মস্থলে যাওয়া মানুষ আছে, তেমনি আছে ভাগ্যের ওপর জীবিকা ছেড়ে দেয়া অনিশ্চিত কর্মের মানুষও। ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথেই একদল মানুষ এখানে বেরিয়ে পড়ে নিজেদের বিক্রি করার জন্য। দিন ও ঘণ্টা চুক্তিতে নিজেদের বিক্রি হওয়ার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা। তবে সেই জীবিকাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে যদি তারা কোনদিন বিক্রি না হন। বাসা-বাড়ির কাজ করার অথবা বিভিন্ন নিমার্ণ কাজের জন্য চুক্তি অনুযায়ী সকাল থেকেই বিক্রির অপেক্ষা থাকে তারা।

এদেরই একজন মালেক। ষাটোর্ধ্ব লোকটি কোদাল-ঝুঁড়ি নিয়ে অন্যদের সাথে সকাল থেকেই বসে আছেন বিক্রি হওয়ার জন্য। নদী ভাঙনে সর্বশান্ত মালেক দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দিনমজুর হয়ে চুক্তিতে কাজ করে যাচ্ছেন যেটাকে তিনি হাজিরা (চুক্তিতে শ্রম বিক্রি করা) বলছেন। সকাল নয়টার কিছু আগে চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ। সকাল থেকে কাজ পাওয়ার আশায় বসে থাকলেও তখনও বিক্রি হতে পারেননি তিনি। কারণ ৯টা পরে আর এই শ্রম কেনা-বেচা আর হয় না।

মালেকের মতো এমন কয়েক’শ ভাসমান শ্রমিক প্রতিদিন কাজের জন্য অপেক্ষায় থাকে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর সড়কের পাশের লেবার মার্কেটে। ভোর হতেই কেউ কোদাল-ঝুঁড়ি নিয়ে, কেউবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, কেউবা রং করার জন্য ব্যবহৃত জিনিসসহ হাজির হয় এই মার্কেটে। দিন ও ঘণ্টা চুক্তিতে এসব শ্রমিকদের কিনে নিয়ে যায় কাজের লোকের খোঁজে আসা মানুষ।

৪০০ থেকে শুরু করে ৮০০ টাকা চুক্তিতে বিক্রি হয় এসব ভাসমান শ্রমিকরা। নারী-পুরুষ সব বয়সী শ্রমিক পাওয়া যায় এই লেবার মার্কেটে। এদের মধ্যে যেমন পেশাগত কাজ করার জন্য আছে রাজমিস্ত্রি-রংমিস্তি তেমনি আছে ইট-বালু সিমেন্ট বহন করার শ্রমিক। আছে বাসা-বাড়ির কাজের নারী শ্রমিকও।

সরেজমিনে লেবার মার্কেটে গিয়ে চোখে পড়লো কয়েক’শ মানুষের জটলা। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাওয়ার আগেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়’ লোক লাগবে? কী কাজ? হাজিরা(কাজে যাওয়াকে হাজিরা বলে) যাবো। এমন কাজ পাওয়ার বিভিন্ন প্রশ্ন। কোন একজন শ্রমিকের সাথে কথা বলতে গেলেই কয়েক জন শ্রমিক এসেই চারিপাশে ঘিরে ধরে। সবারই কাজ পাওয়ার চেষ্টা। কাজের তুলনায় এখানে শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ শ্রমিক থাকলেও সেখান থেকে কাজ পাচ্ছেন ২০০ মতো শ্রমিক। অনেক সময় সেটা কম বেশিও হয়ে থাকে। বাকি লোকগুলো কাজ না পেয়ে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় তাদের।

১৫ বছর ধরে এই লেবার মার্কেট থেকে দিনমজুর হিসেবে কাজে যান সালমা খাতুন। চল্লিশোর্ধ্ব সালমারও অপেক্ষা কাজ পাওয়ার। সালমার কথায় উঠে আসে আক্ষেপের সুর। একজন পুরুষ শ্রমিকের মতো কাজ করলেও সেখানে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি পাচ্ছেন পুরুষের অর্ধেক মজুরি।

তার মতে অন্য কোন কাজে গেলে সেখানে রুটিন মাফিক কাজ করতে হবে। কিন্তু লেবার মার্কেটে যেদিন সে চাইবে সেদিন এসে কাজ পেলে কাজ করতে পারবে। জানালেন, এই কাজ করেই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাচ্ছেন তিনি। এখন তার একমাত্র চাওয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই অন্য কোন নিশ্চিত কাজে যাবেন তিনি।

১২ বছর ধরে এই লেবার মার্কেট থেকে কাজ পেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন সাইফুল(২৩)। তার কথায় উঠে আসে লেবার মার্কেটের করুণ দশার কথা। আগে ভালো কাজ পেলেও এখন আর আগের মতো কাজ পায় না তারা। প্রতিদিন ৫০০/৬০০ শ্রমিকের বিপরীত কাজের জন্য শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছেন ৫০ থেকে শুরু করে ২০০ জনের মতো। ফলে এখানে কাজের লোকের সংখ্য বেশি থাকায় কম দামে শ্রমিক নিতে চায় মালিক পক্ষ।

সালমা সাইফুলদের মতো অন্যন্য শ্রমিকরাও এখানে প্রতিদিন কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। কোন একজন লোক শ্রমিক নিতে এসেছেন বুঝতে পারলেই সবাই গিয়ে ঘিরে ধরে তাকে কাজে নেয়ার জন্য। এতে করে অনেক সময় শ্রমিক নিতে আসা ব্যক্তিদেরও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।

শ্রমিক নিতে আসা এক ব্যক্তি থামার সাথে সাথেই তাকে ঘিরে ধরে ২০/২৫ জন শ্রমিক। সবাই জোর করছে তাকে কাজে নেয়ার জন্য। কাজের হাহাকার পড়ছে এমন অবস্থায় দেখা গেল। এক পর্যায়ে মোটরসাইকেলে আসা লোকটি বিরক্ত হয়ে লোক না নিয়েই চলে যেতে লাগলো।

কাছে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বিডিমর্নিংকে বলেন, ‘এখানকার লোক ভালো কাজ করে। এক বেলা খেতে দিলেই ওরা খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করে। তাছাড়া এখান থেকে দামাদামি করেও লোক নেয়া যায়।’

অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্য বাসার কাজের জন্য একজন শ্রমিক নিতে এসে শ্রমিকদের আচরণে অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দরদাম করে একজন শ্রমিক নিলেও অন্য শ্রমিকরা সেই দামে তাকে যেতে দেয় না।’

অন্যদিকে শ্রমিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, বিভিন্ন এনজিও লোকজন এখানে এসে শ্রমিকদের সাথে মোবাইলে চুক্তি করে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজের জন্য পাঠায়। ফলে এখন আগের মতো দামে কাজ পাওয়া যায় না।

একই চিত্র দেখা যায়, রাজধানীর আজিমপুর বাসস্টান্ড সংলগ্ন লেবার মার্কেটে(শ্রমিক কেনা-বেচার বাজার)। সরেজমিনে এই লেবার মার্কেটে কথা হয় হানিফের সাথে। পঞ্চোর্ধ হানিফ দীর্ঘ ২৫ বছর ওমানে থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় দেশে ফিরে রাস্তায় কাজের জন্য বিক্রি হওয়ার অপেক্ষায় আছেন হানিফ। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বাড়িঘর বলতে আছে সামান্য ভিটেমাটি। পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই বসবাস করেন।

রাস্তার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দুশ্চিন্তার ভার মাথায় নিয়ে তিনি বিডিমর্নিংকে জানান, প্রতিদিন সকাল হলেই কাজের জন্য এখানে অপেক্ষা করেন তিনি। কাজ না পেলে বাসায় গিয়ে বেকার সময় কাটাতে হয়। সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন কাজ পান তিনি। অন্য সময় বেকার থাকতে হয়।

তাহলে সংসার চলে কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকটা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে জানান, কাজ না পেলে বিদেশে থাকতে জমানো টাকা থেকে সংসারের খরচ বহন করেন তিনি। তবে এভাবে দিনের পরে দিন কাজ না পেলে এক সময় তো জমানো টাকা থাকবে না। সে হিসাব তিনি আর মেলাতে পারলেন না।

বাজার করা প্যাকেটে করে খাবার নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে পান চিবাচ্ছেন রোমিয়া ও আফরোজা। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলেই অনেকটা আক্ষেপের সুরে জানালেন, তারা আর কী বলবে? কাজের জন্য সকাল থেকে বসে থাকলেও বেশিরভাগ দিন কাজ না পেয়েই ঘরে ফিরতে হয় তাদের। অভিমান আর ক্ষোভের পরিমাণটাও কম নয় তাদের। পুরুষের সমপরিমাণ কাজ করলেও মজুরি পান তার অর্ধেক। রোমিয়া আফরোজার মতো এক লাইনে আরো ৩০-৪০ জন নারী শ্রমিক কাজের জন্য অপেক্ষা করছেন।

এক সময় কাপড়ের ব্যবসা করতেন আবদুর রহিম। সুসময় ছিল তার। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান খেয়ে গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে্ ঋণ শোধ করেছেন। এরপর থেকে প্রায় ২০ বছর ধরে এই্ লেবার মার্কেটে এসে কাজের জন্য যান তিনি। যেদিন কাজ পান সেদিন কাজ যান আর না হলে বাসায় থাকেন অথবা অন্য কাজ করেন।

তবে নিজের ব্যবসা হারিয়ে রাস্তার পাশে শ্রম বিক্রির অপেক্ষায় থেকেও আক্ষেপ নেই তার। কোনভাবে পরিবার নিয়ে তিন বেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছেন এটাই অনেক কিছু তার কাছে। রাজমিস্ত্রির কাজ থেকে শুরু রংমিস্ত্রির কাজ সবকিছুই করতে পারেন তিনি। যেদিন যে কাজ হয় সেই কাজেই চলে যান।

রহিম, হানিফদের মতো এমন শতাধিক ভাসমান শ্রমিক কাজের অপেক্ষায় থাকেন এই লেবার মার্কেটে। শুধু আজিমপুর বা আজমপুর নয়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, হাজারীবাগ, সায়েদাবাদ, গাবতলী, সদরঘাট, মোহাম্মাদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন সকাল হলেই শ্রম বিক্রি করার অপেক্ষায় থাকে কয়েক হাজার ভাসমান শ্রমিক। যাদের মধ্যে থেকে অর্ধেকরও কম শ্রমিক প্রতিদিন কাজ পায়। অন্যরা কাজ না পেয়ে ফিরে যায় বাসায়। অর্থ্যৎ কাজ করতে ইচ্ছুক এবং কাজ করার ক্ষমতা থাকলেও একটা বিরাট সংখ্যার শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২২ লাখ ৩২ হাজার মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। এসব মানুষের বেশিরভাগই কাজের সন্ধানে ঘরছাড়া হয়ে দেশের বিভিন্ন শহরের বস্তিতে বসবাস করছে। এর মধ্যে রাজধানীতে বস্তিবাসীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬২ হাজার। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে এসে সেখানে বাস করছে। আর এসব মানুষের মধ্যে ৫০ শতাংশই ভাসমান শ্রমিক। যাদের নিদিষ্ট কোনো কাজ নেই। অনাহার-অর্ধাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। এ থেকে উত্তরণের কোন পথ তাদের সামনে খোলা নেই। যে গ্রাম জীবিকার তাগিদে শহরে ঠেলে দিয়েছে সেই গ্রামও হয়তো তাদের আর নিবে না। কারণ সেখানে বেশিরভাগ শ্রমিকের এখন আর কিছুই নেই। নদীগর্ভে অথবা ঋণ শোধ করতে গিয়ে সব হারিয়ে নি:স্ব মানুষগুলোর এখন একটাই জীবন। কাক ডাকা ভোরে রাস্তায় এসে বসে থাকা। আর অপেক্ষা, কখন মিলবে কাজ, কখন জুটবে আহারের সংস্থান।

Bootstrap Image Preview