Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

বিভ্রান্তির বেড়াজালে ঐতিহ্যবাহী আশুরা, নিষিদ্ধ কিছু বিষয়াবলি

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:১৪ PM
আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:১৪ PM

bdmorning Image Preview


'আশুরা' শব্দটি আরবি। 'আশারা' শব্দমূল থেকে নির্গত। এর অর্থ দশ। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহররমের দশম দিবসকে 'আশুরা' বলে অভিহিত করা হয়। হিজরি বর্ষের সূচনা হয় এ মহররম মাসের মাধ্যমেই। 'মহররম' শব্দের অর্থ পবিত্রতম ও মর্যাদাপূর্ণ। ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে এ মাসকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখা হতো। এর পবিত্রতা ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করেই যুদ্ধপ্রিয় আরবরা এ মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে 'মহররম' বা 'মর্যাদাপূর্ণ' বলে। এ মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, হাদিস শরিফে এ মাসকে 'আল্লাহর মাস' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- 'নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ ও সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এসব মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না' (সুরা : তাওবা-৩৬)।

হাদিস শরিফে এসেছে, এ চারটি মাস হলো, জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। কাজেই সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই এ মাসটি বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে আসছে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর ইতিহাসের অসংখ্য কালজয়ী ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে পুণ্যময় এ মাস। আর কারবালার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিও আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে শোকাভিভূত এক নতুন অধ্যায়।

আশুরার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আশুরা দিবসকে কেন্দ্র করে রচিত ও সংকলিত হয়েছে ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনাপ্রবাহ। নবী-রাসুলদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আশুরার মর্যাদাবাহী অসংখ্য ঘটনা-উপাখ্যান-বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন আশুরার দিন হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা, ওই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো, একই দিনে তাঁর তওবা কবুল হওয়া, এই দিনেই হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও নমরুদের প্রজ্ব্বলিত আগুন থেকে মুক্তি লাভ, হজরত আইউব (আ.)-এর আরোগ্য লাভ, হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পাওয়াসহ অসংখ্য ঘটনার বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। নিছকই ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সেসব ঘটনার বিশেষ আবেদনও রয়েছে বৈকি? তবে হাদিস শরিফে আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে এসেছে- হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন, মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজি (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আশুরার দিন তোমরা রোজা রাখো কেন? তারা উত্তর দিল, এটি একটি মহান দিন- এ দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। এরপর রাসুল (সা.) বলেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। তার পর থেকে তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।- বোখারি : ৩৩৯৭, মুসলিম : ১১৩৯। অন্য এক হাদিসে এসেছে, 'এটি সেদিন, যেদিন নুহ (আ.)-এর কিশতি 'জুদি' পর্বতে স্থির হয়েছিল।' তাই নুহ (আ.) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ সেদিন রোজা রেখেছিলেন।'- মুসনাদে আহমাদ ২/৩৫৯। ইতিহাসের ঘটনাপরম্পরায় ৬০ হিজরির ১০ মহররম সংঘটিত হয় কারবালার হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। সেদিন পাপিষ্ঠরা যে নির্মমতা ও নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছে, তা পাথরসম যেকোনো হৃদয়েই সমবেদনার কম্পন জাগিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহাদাতের পর হজরত হুসাইন (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শার এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছাড়াও অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল।

আশুরা মানেই কারবালা নয়

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আশুরা মানেই কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নয়, আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই চলে আসছে। এর ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে। ইসলামের আবির্ভাবেরও বহু আগ থেকে। এমনকি আশুরার রোজার প্রচলন ছিল ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও! হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সা.)-এর কাছে আশুরার দিবস সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন, এই দিন জাহেলি যুগের লোকেরা রোজা রাখত...(মুসলিম : ২৬৪২)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুল (সা.)-ও আশুরার রোজা রাখতেন (মুসলিম : ২৬৩২)। কাজেই আশুরার সুমহান ঐতিহ্যকে 'কারবালা দিবসে'র ফ্রেমে বন্দি করা কেবলই সত্যের অপলাপ নয়; একই সঙ্গে দুরভিসন্ধিমূলকও!

আশুরার দিবসে করণীয়

প্রতিটি ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম দুটি শর্ত রয়েছে। এক. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। দুই. ওই ইবাদত রাসুল (সা.)-এর আনীত শরিয়ত এবং বর্ণিত পথ ও পন্থা অনুসারে হওয়া। আশুরার দিবসে রোজা রাখা ছাড়া অন্য কোনো রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ইবাদত ইসলাম অনুমোদন করে না। তাই কেবল রোজা রাখার মাধ্যমেই দিনটিকে পালন করতে হবে।

আশুরার নিষিদ্ধ বিষয়াবলি

আশুরার সুমহান মর্যাদা ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে কিছু নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কারের প্রচলন হয়ে গেছে। সেসব থেকে বেঁচে থাকা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত তালিকা উপস্থাপন করা হলো। মহররম আসার সঙ্গে সঙ্গে হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ওপর মাতম-বিলাপ শুরু করা ও নিজ দেহে ছুরিকাঘাত করা গর্হিত অপরাধ। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'শোকে বিহ্বল হয়ে যে ব্যক্তি গাল চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে ও জাহেলি যুগের মতো আচরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।'- বুখারি : ১২৯৭। এ ছাড়া কালো পতাকা উত্তোলন, রাত জাগা, দুলদুল কবর ইত্যাদির আকৃতি বানানো, সাজসজ্জা ও আরাম-আয়েশ ত্যাগ করা, মর্সিয়া করা, পুঁথি পাঠ করা, হালুয়া-রুটির হৈ-হুল্লোড় করা, শোকমিছিল বের করা, আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করা বিদআত। আর এসবের মধ্যে এমন কাজও রয়েছে, যেগুলোতে শিরকের আশঙ্কা থাকে। অতএব এসব কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। আবার কেউ কেউ আশুরাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কল্পিত ঘটনা ও বিশেষ বিশেষ পন্থায় ইবাদতের উপদেশ দিয়ে থাকেন- এ সব কিছু নিন্দনীয় ও বর্জনীয়। অনেক 'আশেকানে কারবালা'কে দেখা যায়, মহররমজুড়ে ওয়াজ মাহফিলের নামে ভিন্ন মতাদর্শীদের গালাগাল করে থাকেন, এ সব কিছু দাওয়াত ও উপদেশের বৈধ পন্থা নয়।

আশুরা সম্পর্কে মনীষীদের অভিমত

বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেন, 'হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের দিনটিকে যদি মাতম বা শোক দিবসের জন্য এতই গুরুত্ব দেওয়া হতো, তবে সোমবার দিনটিকে আরো ঘটা করে শোক দিবস হিসেবে পালন করা অধিক বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ, এ দিন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনেই নবীর পর শ্রেষ্ঠ মানব প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।'- গুনিয়াতুত তালেবীন, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৮

এ সম্পর্কে আল্লামা রুমি (রহ.) বলেন, 'হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের কারণে রাফেজিদের মতো এ দিনটিকে মাতমের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া, বস্তুত দুনিয়ায় নিজেদের পুণ্যময় সব কাজের বিনাশ করার নামান্তর।'- ফতোয়ায়ে রহিমিয়া, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৪১-৩৪২

হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, 'মহররমের ১০ তারিখ পবিত্র কোরআনকে সাজিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা এবং তা মাথায় চড়িয়ে অলি-গলিতে প্রদর্শন করা, তার নিচে গিয়ে মাথা লাগানো, চুমো খাওয়া, ঢাকঢোল পেটানো একেবারেই ভিত্তিহীন কাজ। এর দ্বারা সওয়াবের আশা করা একেবারেই বৃথা।'- ইমদাদুল ফাতওয়া, খণ্ড-৫, পৃ. ৩৪৮

হজরত মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) বলেন, কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলমানদের অন্তরকে সব সময় ব্যথিত করে। শুধু ১০ মহররমকে শোকের জন্য বেছে নেওয়া বোকামি বৈ কিছুই নয়।- ইমদাদুল মুফতিয়ীন, খণ্ড-১, পৃ. ৯৬

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সত্য কথা বলার, উপলব্ধি করার ও সত্যের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক :মুফতি শাহেদ রহমানি, সিইও, সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিক্স বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা।

Bootstrap Image Preview