Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

'পিঁপড়ার বংশধর রুবেল মিয়া'

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:৪১ AM
আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৫:২২ PM

bdmorning Image Preview
মিনথি রুবেল মিয়ার সাথে কথা বলছেন প্রতিবেদক। ছবি: মেরিনা মিতু


ফারুক আহমাদ আরিফ-

রুবেল মিয়া। বয়স ৩৫ হতে ৪০ এর মাঝামাঝি। দেহের ওজন ৪৫ কেজি। কিন্তু বোঝা বহন করেন ৮০ কেজি। নিজের দেহের ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ ভার বহন করতে হয় তাকে।

আর এই ভার বহন তাকে প্রতি রাতেই করতে হয়। ঘরে এক ছেলে তিন মেয়ে। বড় মেয়েটি আগামীতে এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। ছেলেটি পড়ছে মাওলানা লাইনে (কওমি) কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বাড়ি। জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর আসনের এমপি। দু'পাশে পেঁয়াজের ঝাঝালো আর চোখ জলসানো রং। বাতাসে পেঁয়াজের শুকনো মোড়কগুলো উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। তারই পাশে একটু ফাঁকা জায়গায় বসে বিশ্রাম নিতে চেষ্টা করছে। পাশে খাঁচা যাকে আমরা বলি মিনথি। এই মিনথি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান পাইকারের সাথে। কাছে গিয়ে বসে কথা বলতে চাইতেই হাসিমুখে সাড়া দিলেন। যেন অনেক দিনের চেনা। 'দৈনিক কত টাকার কাজ করতে পারেন' এমন প্রশ্নে তিনি জানালেন ৭ থেকে ৮ শত টাকা। থাকা, খাওয়া আনুষঙ্গিক বাদ দিলে ৪০০ টাকা থাকে। কত কেজি ভার বহন করেন? সাধারণ ৭০-৮০কেজি। আপনার দেহের ওজন? ৪৫ কেজি। ঘাড়ে ব্যথা পান না? জী পাই, কি করবো! কাজ তো করতে হবে।

নজরুল সুঠাম দেহ। বয়স ৪৫ এর উপরে। বাড়ি ভোলা। শরীর দিয়ে বৃষ্টির মতো ঘাম পড়ছে। মাথায় বিশাল মিন্তি। কত কেজি ভার বহন করেন? ৮০ কেজি, ৮৫ কেজি। ঘাড়ে, শরীরে ব্যথা পান না? পাই। ব্যথার কথা চিন্তা করলে তো পেট চলবে না। দৈনিক ৬০০ টাকা উপার্জন করি। ঘাড়ের ব্যথার কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে ৩ থেকে ৪০০ টাকা উপার্জন হবে। এই টাকা দিয়ে সংসার চলবে?

রুবেল মিয়া, নজরুলসহ কয়েকশ মিনথি কাজ করেন কারওয়ান বাজারে। তাদের দেহের ওজনের চেয়ে বোঝার ওজন বেশি বহন করতে হয়। তারা জানালেন, একজন মালিক (পাইকার) যেগুলো মাল কেনেন সবগুলো তাদের এক মিনতি করে সাথে সাথে যেতে হয়। আলাদা হওয়ার সুযোগ নেই। তাই কষ্ট সয়ে গেছে। পিঁপড়া যেমন তার দেহের ওজনের চেয়ে ৩৯ গুণ বেশি বোঝা বহন করে তেমনি রুবেল মিয়ারা হচ্ছেন পিঁপড়ার বংশধর। আক্ষেপে জানালেন রুবেল মিয়া।

পান প্রস্তুত করছেন 'পানখোর' মো. সাইফুল ইসলাম। ছবি: মেরিনা মিতু

পানখোর নামে পরিচিত মো. সাইফুল ইসলাম। জামালপুরে বাড়ি। প্রতি রাতে পান লাগে ৬০ থেকে ৭০ খানা। পেঁয়াজের লাল রঙের সাথে পানের লাল রং এক সাথে মিশে গেছে। হাসিশুশি সাইফুল বললেন, ঘুম তাড়াতে পান খাই।

এতাে পান খান কেন এমন প্রশ্নে সাইফুল বললেন বিড়ি-সিগারেট বাজে কিছু খাই না। ঘুম তাড়ানোর জন্যে পান খাই। বেশি পান খেলে তো ভাত বা অন্য খাবার বেশি খাওয়া যায় না? বিনম্রভাবে বললেন সাইফুল অভ্যস হয়ে গেছে।

বিটু বিশ্বাসের সাথে কথা বলছেন প্রতিবেদক। ছবি: মেরিনা মিতু

কুষ্টিয়ার মিরপুরের মো. বিটু বিশ্বাস। সাইফুলের দোকানে বসে দম নিচ্ছেন (বিশ্রাম)। পড়ালেখা জানা থাকলে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর চৌকশ সদস্য হতে পারতো। কিন্তু ভাগ্য তাকে এনে দাঁড় করিয়ে কারওয়ান বাজারের শ্রমিকে। বিটু জানালেন, এখানে মানুষ মরে থাকলেও কেউ খবর নেয় না। কেন অযথা যামেলায় জড়াবো? এমন প্রশ্নে দূরে সরে যায় মানুষ।

সবুজ মিয়া হাসিখুশি মুখে যেভাবে গ্রাহকদের সহযোগিতা করছেন দেখে অবাক হতে হলো।

টাকা গুনছেন পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সরুজ মিয়া। ছবি: মেরিনা মিতু

আরেক পেঁয়াজ ব্যবসায়ী নজরুল আপন মনে টাকা গুনছেন তো গুনছেন। কোন দিকে খেয়াল নেই। পাল্লায় টাকা আর টাকা। কিছুক্ষণ পরে কথা হলে জানালেন এখানে সব দিক দিয়ে নিরাপত্তা আছে। কোন চাঁদা দিতে হয় না।

লেবুর পসরা সাজিয়ে বসে আছেন শাহীন। থরে থরে সাজানো লেবু। এগুলো কোথা থেকে নিয়ে আসেন এমন প্রশ্নে শাহীন জানালেন চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে বেশিরভাগ লেবু তারা কিনে আনেন। দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করেন।

ধনেপাতার ঘ্রাণে মন যেন হারিয়ে যায়। ছিপছিপে, লক লকে এক লোক বসে আছেন ধনেপাতার পসরা নিয়ে। কেজি কত? ৭০ টাকা জবাব দিলেন বিক্রেতা। ৫০ টাকা দিবেন? না। ৫/৬ জন খুচরা বিক্রেতা ঘিরে ধরলেন লিকলিকে জাহাঙ্গীরকে। ৫৫ টাকা দিব বললেন ক্রেতা। না, একদাম ৬০ টাকা হলে নিতে পারবেন বললেন জাহাঙ্গীর। সব ক্রেতা চলে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম বিক্রি করলেন না এখন তো এক সাথে ৬ জন ক্রেতা হারালেন? ৫৫ টাকা কেজি কেনাই আছে, কত টাকা লাভ হবে বলুন বললো জাহাঙ্গীর। একশ কেজির বস্তা কিনতে হয়। দোকান ভাড়া দৈনিক ৬০০ টাকা। কয় টাকা থাকে? বাড্ডার আল-আমিন এবং তালতলার নুর ইসলাম খুচরা ক্রেতা। তারাও ফিরে গেল। অনড় জাহাঙ্গী। যখন সব দোকানে বেঁচাকেনা চলছে দেদারছে। ঠিক তখন আনমনে বসে আছেন

ময়মনসিংহের সিম ব্যবসায়ী মজিবর। একের পর এক পাল্লা সিম মেপে যাচ্ছেন। কোন ক্লান্তি নেই। দৈনিক কত কেজি সিম বিক্রি করেন? ৫০ থেকে ৮০ মণ।

ঝিনাইদহের জামাল। বেগুন ব্যবসায়ী। থরে বিথরে সাজিয়ে রাখছেন বেগুন। কথা বলতে চাইলে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। আপনাদের বাতির এ অবস্থা কেন? ভাই আপনি যখন মার্কেটে যাবেন দেখবেন একটি দোকানে অযথা অনেক বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। আমরা এখানে সবুজ বাতি লাগিয়েছি।

অন্ধকারে কাঁচা মরিচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সোলায়মান।

ব্যবসায়ী সবুজ মিয়া। ছবি: মেরিনা মিতু

পেঁয়াজের দোকান। কিন্তু দেখে বুঝা যাচ্ছে একটি রঙিন স্টুডিও। ক্রেতার পথ চেয়ে বসে আছেন সবুজ মিয়া। বাড়ি জামালপুর। তিনি জানালেন কারওয়ান বাজারের বেশির ভাগ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর বাড়ি জামালপুর জেলায়। দোকানে পেঁয়াজের রঙের সাথে তাল মিলিয়ে লাইট ব্যবহারের কারণ কি? এতে করে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়। এখানে সবগুলো দোকানেই মালের (পণ্য) রঙ ধরে লাইট ব্যবহার করা হয়। ৩০ জন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই জামালপুর।

চারপাশে বিক্রির ধুম পড়লেও পিলারে হেলান দিয়ে দোকানে ফাঁকা বসে আছেন আব্দুর রহিম। লহ্মীপুরের রামগঞ্জে তার বাড়ি। কি ব্যাপার বেঁচাকেনা নেই জিজ্ঞাসা করতেই বসতে বললেন। বসলাম বঞ্চে। মাল আসেনি ভাই। বিক্রি বন্ধ-বললেন আব্দুর রহিম। কখন আসবে? ঠিক নেই। আব্দুর রহিম জানালেন সারা রাত বেঁচাকেনা করতে হয়। দিনে গিয়ে ঘুমান। তাই আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার সময় পান না। কর্মচারী দিয়ে ব্যবসা করা যায় না? এখানকার জগৎ একটু ভিন্ন। নিজে থাকলে বেঁচা ভালো। দূরে থাকলে বেঁচা কম। তাই বাধ্য হয়ে সব মালিকই থাকে।

লেবু নিয়ে রাজার হালতে বসে আছেন সফির উদ্দীন। ময়মনসিংহের ত্রিশালের বাসিন্দা। এখন কোথা হতে লেবু আসে? চট্টগ্রাম, সাগরদিঘী। সাগরদিঘীর কি অবস্থা? লোকজন দখল করে সেখানে লেবু বাগান করছে।

৫০ টাকা মায়নায় কাজ করতেন হেমায়েত। আজ সে আড়তের মালিক। তিনি জানালেন নিজের উঠে আসার কথা। আমি সব সময় পরিশ্রম করি। কাজ করি। বসে থাকি না। কাজ না করলে মানুসের থাকে কি বলছিল হেমায়েত।

Bootstrap Image Preview