দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে আসা পর্যটকরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে ছদ্মবেশী ছিনতাই ও প্রতারক চক্রের কাছ থেকে। কৌশলে তারা ময়নামতি শালবন, শালবন বৌদ্ধবিহার, ময়নামতি যাদুঘরসহ বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে আসা ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে লুটে নিচ্ছে দামী ক্যামেরা, মোবাইল, নগদ অর্থসহ মূল্যবান মালামাল। দিন দিন স্থানীয় একটি ছিনতাইকারী চক্র একাজ করে যাচ্ছে নিরবে বলে জানা যায়।
সরেজমিন ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন বা সভ্যতা লালমাই-ময়নামতিকে ঘিরে। উনিশ শতকের ৫০’র দশকের শুরুতে এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর খনন শুরু হয়। প্রথমে শালবন বৌদ্ধ বিহার। তারপর একে একে ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, আনন্দ বিহার, ভোজবিহার, চারপত্র মুড়া, চন্ডিমুড়া, রানী ময়নামতি প্রাসাদ প্রমূখ। উদ্ধার হয় এসব ঐতিহাসিক স্থাপনার খনন থেকে অনেক দুস্প্রাপ্য স্বর্ন, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ মুদ্রা, কষ্টি পাথরের মূর্তি, বুদ্ধের আবক্ষ মূর্তি, মাটির তৈরী বিভিন্ন পাত্র, লোহার পেরেকসহ অনেক কিছু।
পরবর্তীতে উদ্ধার হওয়া প্রাচীন জিনিসগুলো সংরক্ষণে তৈরী হয় শালবন বিহারের পাশেই ময়নামতি যাদুঘর। দেশের গন্ডি পেরিয়ে উল্লেখিত ঐতিহাসিক নিদর্শন ও উদ্ধার হওয়া প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের খবর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বিভিন্নস্থানসহ নানা দেশ থেকে আসতে থাকে হাজার হাজার দর্শনার্থী। বহিঃবিশ্বে পরিচয় ঘটে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর। এভাবে দিন দিন লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে আবিস্কৃত নিদর্শনগুলোর পরিচয়ে বাড়তে থাকে ভ্রমনকারীর সংখ্যাও। কিন্তু যেভাবে বাড়ছে ভ্রমণকারীর সংখ্যা, সেভাবে তাদের সুরক্ষায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়নি। ফলে শালবন বৌদ্ধ বিহার, প্রাকৃতিক শালবন, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, রানী ময়নামতি প্রাসাদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধি ক্ষেত্র এলাকায় প্রায়ই ভ্রমণকারীরা ছিনতাইকারী বা প্রতারকদের কবলে পড়ে মূল্যবান মালামাল হারাচ্ছে। বাধাঁ দিতে গিয়ে হচ্ছে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত। এক্ষেত্রে দর্শনার্থীরা প্রথমে যে বিষয়টি দুষছেন সেটা হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সুত্র জানান, শালবন বৌদ্ধ বিহার ও ময়নামতি যাদুঘর’এ কিছুটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও বাকীগুলোতে নেই সে ব্যবস্থা। দিন দিন এসকল নিদর্শনগুলোতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়নি। চট্টগ্রাম হালিশহর থেকে মাসুদ নামের এক ঠিকাদার গত রমজান মাসে পরিবার নিয়ে শালবন, বৌদ্ধবিহার এলাকায় এসে হয়রানীর শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, আমরা সুরক্ষিত প্রাচীর ঘেরা শালবন বৌদ্ধ বিহার এলাকাতেই ছদ্মবেশী ছিনতাইকারীদেও কবলে পড়ে মূল্যবান ক্যামেরা হারিয়েছি। ওই ছিনতাইকারী চক্রের একজন আমাদের ছবি তোলার প্রস্তাব দিয়ে মূল্যবান ক্যামারাটি নিয়ে দৌড়ে বৌদ্ধ বিহারের সীমানা প্রাচীর টপকে পালিয়ে যায়।
ঈদুল আযহার কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে ৪ জনের একটি সৌখিন ফটোগ্রাফার গ্রুপ এসেছিল এখানে। পরবর্তীতে যাদুঘর ঘুরে শালবন বৌদ্ধবিহারে প্রবেশের পর ছবি তোলার প্রস্তাব করে ক্যামেরাটি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে ছিনতাইকারীরা। অবশ্য তাদের কৌশলের কারণে ক্যামেরাটি নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেনি। এছাড়াও প্রাকৃতিক শালবন, ইটাখোলা ও রূপবান মুড়া,রানী ময়নামতি প্রাসাদ, চন্ডিমুড়া এলাকায় প্রতিনিয়তই ভ্রমণকারীরা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মূল্যবান মালামাল হারানোর পাশাপাশি ইভটিজিং ও যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন। হয়রানীর ভয়ে কেউই থানায় যেতে সাহস পাচ্ছেননা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সুত্র জানান, লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের কোটবাড়ি, সালমানপুরসহ আশপাশ এলাকার একটি চক্র সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শালবন বৌদ্ধ বিহারে দর্শনার্থীর ছদ্মবেশে প্রবেশ করে ছিনতাই করছে। একইভাবে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা টার্গেট করে পিছু নিয়ে ইটাখো বা রূপবান মুড়া এলাকায় গিয়েও ছিনতাই করে বিভিন্ন মুল্যবান মালামাল। এছাড়াও শালবন বৌদ্ধ বিহার ও প্রাকৃতিক শালবনটিতে সন্ধ্যার পর থেকেই ছিনতাইকারী, বখাটে, মাদকসেবীদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, শুধুমাত্র ময়নামতি যাদুঘর ছাড়া বাকী সবগুলো ঐতিহাসিক নিদর্শন রাতে অরক্ষিত থাকে। এসুযোগে সীমানা প্রাচীর টপকে অপরবাধীরা শালবন বৌদ্ধবিহারে রাতের আধাঁরে প্রবেশ করে। প্রাকৃতিক শালবনটি এমনিতেই খোলা।
বিষয়টি জানতে চাইলে ময়নামতি যাদুঘরের কাষ্টডিয়ান ড. আহমেদ আবদুল্লাহ বলেন, প্রায়ই অনেক দর্শনার্থী বা ভ্রমণকারী এসে আমাদের কাছে অভিযোগ করে। তখন আমরা আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের অভিহিত করি। তবে বৌদ্ধবিহারের পূর্ব ও উত্তর দিকের সীমানা প্রাচীর দিয়ে অপরাধীরা নির্বিঘ্নেপালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। তিনি আরো বলেন, যদি স্থানীয় ফাঁড়ি ও ট্যূরিষ্ট পুলিশের নিয়মিত টহল ব্যবস্থা থাকতো তবে, অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি একদল দর্শনার্থীর কাছ থেকে কৌশলে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পর তারা ছিনতাইকারী এক যুবকের ছবি তুলে তার কাছে দেয়। কিন্তু লিখিত অভিযোগ না থাকায় তিনি কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
এখানকার নিরাপত্তার বিষয়টি জানতে চাইলে সদর দক্ষিণ থানার ওসি (তদন্ত) কমল কৃষ্ণ ধর জানান, ওই এলাকাটা আমাদের থানাধীন কোটবাড়ি ফাঁড়ি পুলিশ দেখে। আমাদের মোবাইল টিম সব সময় এসকল এলাকায় কাজ করছে। আমাদের কাছে কখনো এই রকম কোন অভিযোগ আসে নাই।
কুমিল্লা ট্যূরিষ্ট পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছির উদ্দিন জানান, আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত এই ধরনের কোন অভিযোগ আসে নাই। আমাদের লোকজন উল্লেখিত এলাকাগুলোতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। আমরা এই ধরনের ছদ্মবেশীদের চিনতে পারলে অবশ্যই আটক করব।