প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, রাজনীবিদ আবুল মনসুর আহমদের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে ১৫ মার্চ তাঁর সন্তান ‘দি ডেইলি স্টার’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের মুখোমুখি হয় বিডিমর্নিং। সন্তানের স্মৃতিচারণায় পিতার জীবন ও কর্ম নিয়ে বিডিমর্নিংকে তিনি বিশেষ সাক্ষাৎকার দেন ডেইলি স্টারের নিজ কার্যালয়ে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বিডিমর্নিং এর হেড অফ নিউজ ফারুক আহমাদ আরিফ। ক্যামেরায় ছিলেন মাজেদুল হক তানভীর ও আশ সাকির গাজী। আজ দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো।
ফারুক আহমাদ আরিফ: স্যার, আমরা আপনার আব্বার আত্মকথা বইটিতে দেখি যে, আপনারা ফরাজি বংশের সন্তান। সেই ফরাজি বংশের অনেকগুলো বেরিয়ার (বাধা) টপকে টপকে তৎকালীন সময়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট আন্দোলন তথা প্রজা আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা ধরনের আন্দোলন করেছেন তিনি। সেই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল আপনার দাদার, মানে আপনার আব্বুর চাচার। তিনি তাকে সবচেয়ে বেশি স্প্রিড দিয়েছেন। তো স্যার, আমাদের কথা হচ্ছে তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, লেখক ছিলেন। তার আয়না বইটি বিখ্যাত, ভালো লেখেছেন।
মাহফুজ আনাম: ফুড কনফারেন্স।
ফারুক আহমাদ আরিফ: ফুড কনফারেন্স ত অসাধারণ। তিনি বিভিন্ন বই লেখেছেন। তাঁর আত্মকথা বইটিতে দেখি যে, তিনি মন্ত্রী থাকার পরও কি সাধারণভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি রাজনীতি করেছেন। বুদ্ধিজীবী ছিলেন। সমাজ, অর্থনীতি সবদিকে অবদান রেখেছেন। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা শুধু নয়…।
মাহফুজ আনাম: বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা।
ফারুক আহমাদ আরিফ: বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। কিন্তু আপনারা কেউ রাজনীতিতে আসলেন না, এটি কেন?
মাহফুজ আনাম: হে হে…।
ফারুক আহমাদ আরিফ: না, মানে আপনারা কেউ রাজনীতিতে আসলেন না, এটি কেন?
মাহফুজ আনাম: না, আমি বলবো তিনি আমার ও আমাদের ভাইদের তুলনায় তিনি অনেক অনেক উচ্চস্তরের মানুষ ছিলেন। উনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক। আমি ওই সেন্সে খুবই গর্বিত যে, আমি উনার সাংবাদিক দিকটার উত্তরাধিকারী। আমি উনার সাহিত্য পাইনি। আবার আমার কন্যা…।
ফারুক আহমাদ আরিফ: আমেরিকা থেকে…।
মাহফুজ আনাম: না, ব্রিটেন থেকে। ও সাহিত্যিক হয়েছে, তো আব্বা জীবিত থাকলে কত যে খুশি হতেন। তাঁর নাতনি তাঁর সাহিত্যিক ঐতিহ্য পেয়েছে। আমি সাংবাদিকতা পেয়েছি। রাজনীতিতে যায়নি– আসলে পরিবেশ বদলে গেছে। উনারা যখন রাজনীতি করেছেন ওই যে প্রথমে বললাম ঔপনেবেশিক বিরোধী। তারপরে পাকিস্তানে যা আশা করেছিলেন সেখানে দেখবেন যে, বাঙালিদের ইলুশন বিরোধী। কি বলবো– একেবারে হতাশ হলেন। সেখানে আবার পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশে আমি ওই রকম অনুপ্রাণিতবোধ করিনি। যেমন, স্বাধীনতা চেয়েছি, তা পেয়েছি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। গর্বিত আমার সেই ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধের পর সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছি। আমি ইনফেক্ট ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে অবজারভারে জয়েন করি।
ফারুক আহমাদ আরিফ: স্যার, আপনার আব্বুর আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক। ভাষা আন্দোলনের সংগঠক এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু পুস্তিকার তিনটি প্রবন্ধের একটির লেখক।
মাহফুজ আনাম: ভাষার ব্যাপারে উনি কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার আগ থেকেই ১৯৪২, ৪৩, ৪৪ সনে কলকাতায় যে ধরনের বিতর্ক হচ্ছিল যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? সেখানে কিন্তু তিনি সুস্পষ্টভাবে মতামত রেখেছেন রেঁনেসা সোসাইটিতে। উনার বিভিন্ন লেখায় নিজস্ব কলামগুলোতে। সেখানে তিনি স্পষ্টই বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের মানের বাংলার রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা, উর্দু নয়। যদি তখনকার কলকাতার বাঙালি মুসলমানদের বিতর্কটা দেখেন সেখানে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন উর্দু হওয়া উচিত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তো ওই ব্যাপারে উনার খুব খুবই স্পষ্ট ধারণা ছিল। আমি ব্যক্তি আবুল মনসুর সম্পর্কে একটি কথা বলতে চাই উনার আত্ম–সম্মানবোধ ছিল…।
ফারুক আহমাদ আরিফ: ছোটকাল থেকেই।
মাহফুজ আনাম: ছোটকাল থেকেই। একটা মানে অবিশ্বাস্য আত্ম–সম্মানবোধ। আপনি ঐ যে বললেন–আত্মকথায় সেখানে দেখবেন যে, গ্রামের বাড়িতে ছোটবেলায় জমিদারের নায়েবদের সাথে তিনি কি আচরণ করেছেন।
ফারুক আহমাদ আরিফ: তুই কথা একটি আসছে…।
মাহফুজ আনাম: তুই কথা নিয়ে একটা আসছে যে, জমিদারের নায়েব আমার আব্বার দাদাকে বললো তুই। তখন আব্বা ওই নায়েবকে বললেন তুই। যার ফলে (তাঁর) দাদা বললেন, এই তুই বেয়াদবী করস ক্যান। জবাবে আব্বা বললেন, সে আপনার সাথে বেয়াদবী করছে ক্যান? আপনি তো তাঁর চেয়ে বয়সে বড়? এই ধরনের একটা তখন বলতে পারেন তার বয়স ৪ বা ৫ বছর, তাঁর এতো আত্ম–সম্মানবোধ। উনি যখন তাঁর দাদার হাত ধরে কাচারিতে যেতেন থানার কাচারিতে। সেখানে দেখতেন যে হিন্দুরা বসে আছে উঁচু বেঞ্চে আর মুসলমানরা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। এই প্রত্যেকটা ব্যাপারে তারমধ্যে সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং আত্ম–সম্মানবোধ জাগে। তো উনার আত্ম–সম্মানবোধ ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। আরেকটা ছিল স্বকীয়তাবোধ। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের আইডেনটিটিটা কি? এ ব্যাপারে তিনি সারাজীবন লেখে গেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কি সে ব্যাপারে লেখে গেছেন। আরেকটা ছিল উনার রসবোধ। এত একটা তিনি রসবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন, দেখুন উনার ব্যঙ্গ লেখাগুলোতে সবচেয়ে বেশি সাফল্য। উনি কয়েকটা উপন্যাস লেখেছেন কিন্তু উনার মূল রচনা হচ্ছে ব্যঙ্গ রচনা বাংলাতে। তিনি কঠোরভাবে সামাজিক সমস্যাগুলো ব্যঙ্গাত্বকভাবে তুলে ধরে যেমন মানুষকে হাসিয়েছেন, তেমনি সচেতন করেছেন। আরেকটা ছিল উনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। অনেকের আগে তিনি রাজনৈতিক সমস্যাগুলো তুলে ধরতেন। শুধু রাজনীতি নয় শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও। আবুল মনসুর আহমদের বাংলার/পূর্ব পাকিস্তানের পাটের ভবিষ্যৎ কি এই নিয়ে অনেক রচনা আছে। পূর্ব পাকিস্তানের পাটশিল্প কীভাবে প্রসারিত করা যায় তা নিয়ে প্রচুর লেখা আছে। তিনি যখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ক্যাবিনেটে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন করাচিতে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম কিছু বিখ্যাত শিল্পপতিদের লাইসেন্স দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়নে বিরাট অবদান রেখেছেন।
ফারুক আহমাদ আরিফ: বিপ্লব…।
মাহফুজ আনাম: হে, মানে অবদানটা বিরাট ছিল।
ফারুক আহমাদ আরিফ: মানে সেই সময়কার জন্যে বিপ্লব?
মাহফুজ আনাম: হে, অবদানটা… বিরাট ছিল। তখন বাঙালিদেরকে পশ্চিমা সরকাররা লাইসেন্স দিত না। ওই এক বছরে ১৩ মাসের যে সরকার, সোহরাওয়ার্দীর সরকার। তখন আবুল মনসুর আহমদের মন্ত্রিত্বকালে পূর্ব পাকিস্তানে কতগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নিয়ে যদি কেউ রিসার্চ করে তাহলে একটি অসাধারণ চিত্র বেরিয়ে আসবে।
ফারুক আহমাদ আরিফ: স্যার আপনি আত্মসম্মানবোধের কথা বললেন। আমার এখন মনে হলো যে, তিনি আত্মকথা বইটিতে লেখেছেন যে, তখন তিনি দরিরামপুর স্কুলের (আসলে মৃত্যুঞ্জয় স্কুল ময়মনসিংহ) ছাত্র। তিনি পোস্ট অফিসে গেলেন একটি চিঠি ইস্যু করতে। ভদ্রলোক চিঠিটা বাম হাতে নিলেন। তিনি আবুল মনসুর সাহেবও টাকা ফেরত নেওয়ার সময় বাম হাতে নিলেন।
মাহফুজ আনাম: হে, প্রথমে ডান হাতটা বের করেছিলেন। পরে ডান হাতটা সরিয়ে বাম হাতটা বাড়িয়ে টাকা নিলেন। হে হে…।
ফারুক আহমাদ আরিফ: হে হে…। সত্যিই এটা খুব একটা ইন্টারেস্টিং।
মাহফুজ আনাম: তাতেই আপনি বুঝতে পারেন তিনি কত সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়ে তিনি তার আত্ম–সম্মানবোধটা প্রকাশ করেছেন। এটা কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের বিরাট বৈশিষ্ট ছিল। অনেক কিছুই তো আব্বা উপদেশ দিয়েছেন। একটা উপদেশ আমার সব সময় কানে বাজে, তিনি বলতেন ‘বাবা যেখানে সম্মান নাই সেখানে যেওনা, কোনদিন যাবে না, যেখানে সম্মান নাই’। এই কথাটা আমার জীবনে প্রাত–স্মরণীয় একটি ব্যাপার। অনেককিছুই অবশ্যই আব্বার কাছে শিখেছি। আমি একটি উদাহারণ দিলাম মাত্র। তিনি কত সচেতন ছিলেন আত্ম–সম্মানবোধের ব্যাপারে!