Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৯ শুক্রবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রাজা-বাদশাদের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান তাজহাট জমিদার বাড়ি

ফরহাদ আকন্দ, গাইবান্ধা প্রতিনিধিঃ 
প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:৪৮ AM
আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:১৫ AM

bdmorning Image Preview


সকল কাজের অবসন ঘটিয়ে অবসরে বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জন কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দময় কিছু সময় কাটানোর জন্য নিরিবিলি ও সাজানো-গোছানো জায়গায় যেতে কার না ইচ্ছে করে। আবার অনেকেই আছে যারা জানতে চায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা, রাজা-বাদশাদের কথা। দেখতে চায় ঐতিহাসিক সব স্থাপনা। ঠিক এরকম মানুষদের জন্য নিরিবিলি, সাজানো ও গোছানো এক অপরুপ সৌন্দর্যের নিদর্শন হচ্ছে রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি। ঘুরে আসতে পারেন রাজা-বাদশাদের স্মৃতিবিজড়িত অপূর্ব ঐতিহাসিক এই জমিদার বাড়ি থেকে।

প্রায় ৫৬ একর জমির উপর ইউ আকৃতির বিশাল এলাকা জুড়ে ঐতিহাসিক এই তাজহাট জমিদার বাড়িটি। এখানে রয়েছে বিশাল খালি মাঠ, গাছের সারি, বাড়ির দুই পাশে রয়েছে দুইটি পুকুর এবং চারদিকে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ শোভা, ফুলের বাগান, উত্তরে-দক্ষিণে রয়েছে কামিনী, মেহগনি, কাঁঠাল ও আম বাগান। রংপুর অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের পদচারণায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখরিত থাকে এই জমিদার বাড়ি এলাকা। দিনদিন বেড়েই চলছে পর্যটকদের ভীড়। ঐতিহাসিক এই জমিদার বাড়ির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রংপুরের তাজহাট, ডিমলা, কাকিনা, মহুনা, পীরগঞ্জ, বর্ধনকুঠির বেশ কিছু এলাকা এই জমিদারেরই অংশ ছিলো। আর তাদের বংশধরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো। তাদের ছিল বিশাল বিশাল আয়তনের প্রাসাদ। যে সবের মাঝে তাজহাট জমিদার বাড়ি অত্যধিক বিখ্যাত। শিখ ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত মান্নালাল রায় ছিলেন, তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পাঞ্জাব থেকে এদেশে আসেন এবং রংপুরের মাহিগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। মান্নালাল রায় ছিলেন, স্বর্ণকার। ধারনা করা হয়, মান্নালাল রায়ের আকর্ষণীয় তাজ বা রত্নখচিত মুকুটের কারণে এই এলাকার নামকরণ করা হয় তাজহাট।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মান্নালাল রায় তার জীবদ্দশায় অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তিনি ক্রমশ রংপুরের বিভিন্ন জায়গা নিজের কবজায় আনেন এবং আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। মান্নালাল রায়ের নাতি ধনপত রায় বিয়ে করেন, নয়া দুমকার রতন লাল রায়ের নাতনীকে। রতন লাল রায় পাঞ্জাব থেকে অভিবাসন গ্রহণ করেন। ধনপত রায়ের নাতি উপেন্দ্রলাল রায় অল্প বয়সে মারা যাবার কারণে জমিদারির দায়িত্ব তার কাকা মুনসেফ গিরিধারি লাল রায়ের হাতে এসে পরে।

 

 

নিঃসন্তান হবার কারণে তিনি জনৈক গোবিন্দ দাসকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। গোবিন্দলাল ১৮৭৯ সালে এই জমিদারীর উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন খুবই স্বাধীনচেতা এবং জনপ্রিয়। ফলে তিনি ১৮৮৫ সালে রাজা এবং ১৮৯৬ সালে মহারাজা উপাধি গ্রহণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে নিজ বাড়ি ধ্বংশস্তুপের নিচে পড়ে তার মৃত্যু হয়। ১৯০৮ সালে মহারাজা কুমার গোপাল রায় জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

রংপুর শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিন-পূর্বদিকে এই তাজহাট জমিদার বাড়ি অবস্থিত। পূর্বমুখী দোতলা এই বিশাল প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য ৭৬.২০ মিটার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় যে, বিদেশ থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি ১৫.২৪ মিটার প্রশস্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি সরাসরি দোতলায় চলে গিয়েছে। সেমি করিন্থীয় স্তম্ভ দ্বারা সমর্থিত আটকোনা বিশিষ্ট ড্রামির ওপর স্থাপিত গম্বুুজটি প্রাসাদের মাঝ বরাবর ছাদের কেন্দ্র স্থলে অবস্থিত। প্রাসাদের সম্মুখ ভাগের দুই প্রান্তে সেমি আটকোনা বিশিষ্ট উদগত ও মধ্যভাগে একটি ৯-১৪ মিটার উদগত বারান্দা রয়েছে।

উক্ত বারান্দার ছাদের উপর চারটি সুসজ্জিত করিন্থিয় স্তম্ভ ও দুই পাশের উদগত অংশের প্রত্যেকটিতে দুইটি করে একই ধরণের স্তম্ভ রয়েছে। যার উপর ত্রিকোনাকৃতির চাল বিশিষ্ট দুটি কক্ষ রয়েছে। প্রাসাদটির নিচতলায় প্রবেশ পথের পিছনে ২৮.২৯ মিটার থেকে ৩.৭২ মিটার মাপের হলঘর রয়েছে। প্রাসাদের অভ্যন্তরে পুরোভাগ জুড়েই আছে ৩ মিটার প্রশস্ত বারান্দা। তাছাড়া উপরতলায় উঠার জন্য প্রাসাদে কাঠের দুটি সিঁড়ি রয়েছে। এ প্রাসাদে মোট ২২টি কক্ষ রয়েছে। ধারণা করা হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল রায় এটি নির্মাণ করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভবনটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হত। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর ইমারতটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০২ সালে এটিকে বাংলাদেশ সরকার রংপুর জাদুঘরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে সরিয়ে এ প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসে। মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে বেশ  কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ যাতে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি। এর মধ্যে রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের সময়ের কুরআনসহ মহাভারত ও রামায়ণ। পেছনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটা কাল পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি। কিন্তু জাদুঘরের ভিতরে ছবি তোলার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ জাদুঘরের শত বছরের পুরোনা ঐতিহ্যবাহী ও মূল্যবান তিনশটি নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে।

 

উল্লেখযোগ্য নিদর্শন গুলোর মধ্যে রয়েছে, আরবি শিলালিপি, বেলেপাথরের বাংলা শিলালিপি, সাঁওতালদের ব্যবহৃত তীর, বল্লম, পোড়া মাটির পাত্র, পোড়া মাটির ময়ূর, ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাওয়া পিতলের দুর্গা, শিবলিঙ্গ, পাথরের মূর্তি, উল্কাপিণ্ড, ঝাড়বাতি, কালোপাথরের সংস্কৃত শিলালিপি ইত্যাদি।

এগুলো ছাড়াও রয়েছে, বেগম রোকেয়ার স্বহস্তে লেখা চিঠি, তুলট কাগজে সংস্কৃত হস্তলিপি, ফার্সি কবিতা ইত্যাদি। শুধু জাদুঘর নয়, পিকনিক স্পট হিসেবেও পর্যটকদের অন্যতম পছন্দ তাজহাট জমিদার বাড়ি। এছাড়া প্রাসাদের সামনে আছে সুবিশাল শানবাঁধানো তিনটি পুকুর। ভবনের পাশে রয়েছে প্রজাপতি গাছের বাগান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাজহাট জামিদার বাড়িতে ঘুরতে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, সারাজীবন শহরে ঘোরাফেরা করতে ভালোলাগে না। তাছাড়া শহরে সবসময় রাস্তায় অনেক ভীড় থাকে তাই কোথায় ঘুরতে গিয়ে আনন্দ উপভোগ করা যায় না। আর শহরে এরকম নিরিবিলি সাজানো, গোছানো সৌন্দর্যময় মনরোম পরিবেশ পাওয়া যায় না। ভালো সময় কাটানোর একটি যথা উপযোগী স্থান তাজহাট জমিদার বাড়ি। তাই লেখাপড়ার মাঝে সময় পেলেই আমরা সব বন্ধুরা শহরের জীবনকে ছুটি দিয়ে ঘুরতে চলে আসি এই তাজহাট জমিদার বাড়িতে। আমাদের কাছে রংপুরে যেসব ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে তার মধ্যে তাজহাট জমিদার বাড়ি অন্যতম স্থান।

তাজহাট জামিদার বাড়িতে ঘুরতে আসা কয়েকজন দর্শনার্থী বলেন, এখানে ইতিহাস ঐতিহ্যের বেশকিছু নিদর্শন রয়েছে। যেগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে পরিচিত করে দিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। তবে অনেকেই জাদুঘরের পাশাপাশি এখানে পর্যটন ও পিকনিক স্পট গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে দাবি করেছেন। এতে করে একদিকে যেমন ওই অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটবে। অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টির মাধ্যমে ওই অঞ্চলের বেকারত্ব অনেকাংশে কমে যাবে।

যেভাবে যাবেন তাজহাট জমিদার বাড়িতেঃ

সড়কপথ ও রেলপথে রংপুর যাওয়া যায়। যেকোন শহর থেকে রংপুর যাওয়ার জন্য ভালো পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। রংপুর বাসস্ট্যান্ড অথবা রেলস্টেশন থেকে খুব সহজেই রিকশা অথবা অটোতে করে যাওয়া যায় তাজহাট জমিদার বাড়িতে। এতে জন প্রতি খরচ হবে ২০ থেকে ২৫ টাকা।

যেভাবে প্রবেশ করবেন তাজহাট জমিদার বাড়িতেঃ 

জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি টিকিটের দাম ২০ টাকা করে, তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্যে টিকিটের প্রয়োজন নেই। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের জন্য প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ টাকা। সার্কভুক্ত বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য টিকিট মূল্য ১০০ টাকা এবং অন্যান্য বিদেশি দর্শকদের জন্য টিকিটের মূল্য ২০০ টাকা করে। প্রাসদ চত্ত্বরে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে চাইলে গাড়ির জন্যও নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে।

যে সময় খোলা-বন্ধ থাকে তাজহাট জমিদার বাড়িঃ 

গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ৩০ মিনিট মধ্যাহ্নের জন্যে বিরতি আছে। আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ৩০ মিনিট মধ্যাহ্নের জন্যে বিরতি। আর সবসময়ের জন্যেই শুক্রবারে সাড়ে ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার সাধারণ ছুটি এবং সোমবার দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া সরকারি সব ছুটির দিনে জাদুঘর বন্ধ থাকে।

রংপুরে কোথায় থাকবেনঃ

থাকার জন্য রংপুর শহরই সব থেকে উত্তম হবে। এখানে অনেক ভালো মানের হোটেল রয়েছে। আপনার পছন্দমতো যেকোন হোটেলে উঠতে পারেন। খরচ খুব বেশি নয়।

Bootstrap Image Preview