Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২০ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

আকিফারা আমাদের ক্ষমা করবে না

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:২১ AM
আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:২১ AM

bdmorning Image Preview


আল- আমিন হুসাইন।।

‘জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে। চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,  প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অবশেষে সব কাজ সেরে, আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস।’

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার `ছাড়পত্র' কবিতায় এভাবে নতুন শিশুর জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। সড়কের নৈরাজ্য, শিশুর প্রতি হিংস্রতা, মানবিকতা-বিবেকবর্জিত অস্থির পৃথিবীতে বসবাসের জন্য এসেছিল আকিফা। কিন্ত  আমাদের রক্ত দিয়ে আকিফার জন্য বাসযোগ্য, নিরাপদে চলাফেরা করার মতো পৃথিবী তৈরি করতে পারেনি। আকিফা রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তার জন্য কতটা অনিরাপদ এই পৃথিবী।

আকিফা দেখিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা মায়ের কোল। সেই কোলেও নিরাপদ নয় আকিফার মতো শিশুরা। শিশুরা নিরাপদ নয় আজ বাড়ির মধ্যেও। ঘরে-বাইরে প্রতিদিন হিংস্রতা ও পশুত্বের শিকার হচ্ছে আকিফার মতো শতশত শিশু।

গত ২৮ আগস্ট  দুপুরে কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায় মায়ের কোলে চড়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো ৮ মাসের শিশু আকিফা। কিন্তু আকিফা তখনো জানতো না সড়কের নৈরাজ্য তাকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিবে। রাস্তা পার হয়ে যখন ফুটপাতে উঠবে তখনই অস্থির আর বিবেকবর্জিত পৃথিবী মায়ের কোল থেকে ফেলে দিলো আকিফাকে। রাস্তার পাশে থেমে থাকা বাস ধাক্কা দিল মা রিনা বেগমকে। সাথে সাথে কোলে থাকা শিশু আকিফা পড়ে গেল সড়কে। এতেই গুরুতর জখম হোন মা-মেয়ে। নৈরাজ্যের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য দু’দিন যুদ্ধ করে অবশেষে ইতিহাস হয়েই চলে গেল আকিফা।

মায়ের কোলে থাকা আকিফাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাওয়ার ভিডিও দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। সেই ভিডিও দেখে যেকোন মানুষ আতকে উঠেছে। আতঙ্কিত হয়ে সকলেই বলেছে শিশুটি যেন বেঁচে যায়। সবারই একটাই দাবি কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত চালক, হেলপারসহ বাস সংশ্লিষ্টদের।

কিন্তু দু’দিন পরই সকালে ঘুম ভেঙে যারা পত্রিকায়, অথবা খবরে বাবার কোলের আকিফাকে দেখেছে তারা হয়তো আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ছোট্ট আকিফার কাফনে মোড়ানো নিথর দেহটা বুকে নিয়ে কাঁদছে সড়কের নৈরাজ্যে কলিজার টুকরোকে হারানো বাবা হারুন অর রশিদ।

গোলাপী জামা পরিয়ে আকিফাকে পুতুলের পাশে বসিয়ে একটা ছবি তুলেছিলেন বাবা। সেই ছবি আজ স্মৃতি হয়ে রয়েছে বাবার কাছে। ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্তের জন্য অপেক্ষায় থাকা বাবা সেই ছবিটা দেখিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলেছেন, ‘একটু পরেই আমার বাচ্চার শরীরে ছুরি চলবে।’

পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। কাফনের কাপড়ে পলিথনে মোড়ানো নিথর দেহ যে বাবার কোলে উঠেছে সেই বাবা কীভাবে এর ভার সহ্য করবে। আকিফার আত্মা হয়তো বলছে, তোমাদের নিষ্ঠুরতা, তোমাদের অস্থিরতা আমাকে পৃথিবীতে থাকতে দিলো না। মায়ের কোলেও আমাকে নিরাপদে থাকতে দিলো না। আকিফার আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না।

আকিফার বাবা বলেছেন, ‘যোগাযোগমন্ত্রী যেন ভিডিও্টি দেখেন, দেখে ব্যবস্থা নেন। সড়কের নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কতটা ঝুঁকিতে আছি আমার। প্রতিদিন সড়কে প্রাণ দিতে হচ্ছে কত মানুষের। মৃত্যু হচ্ছে কতশত স্বপ্নের তার হিসাব রাখা দায়।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনের পর সড়কে নৈরাজ্য যেন আরও বেড়েছে। বেপরোয়া গতি, পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্য যেন এখন আরও বেড়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্যমতে, ঈদুল আজহায় ১৩ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৫৯ জন, আহত  হয়েছেন ৯৬০। অন্যদিকে গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী, গত ৫৫৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫০২০ জন।

মৃত্যুর মিছিলের এই তালিকা আমাদেরকে আতঙ্কিত করে। কতশত উদ্যোগ, নির্দেশনা নেয়ার পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। কয়েকটি দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল ‍দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা শুধু দুর্ঘটনা নয় এটা এক ধরনের হত্যাকাণ্ড।

কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডার জেরে রেজাউল করিম রনি (৩২) নামে এক যুবককে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে বুকের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে হত্যার ঘটনা, গত ২২ জুলাই চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার বদ্দরহাট এলাকায় শরীর ওপর দিয়ে ট্রাক উঠিয়ে আমানুল্লাহ নামে এক বেকারী কর্মীকে হত্যা, তারও এক দিন আগে ২১ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েলকে আহত অবস্থায় নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করার ঘটনা ও সব শেষ শিশু আকিফার মুত্যু দেখিয়ে দিয়েছে সড়কে দুর্ঘটনা এখন হত্যাকাণ্ডে রূপ নিয়েছে।

পৃথিবীর সব দেশে সড়ক দুর্ঘটনা হয়। আমাদের এখানে সড়ক  দুর্ঘটনা নিয়ে বেশি হওয়ার কারণ জবাবদিহিতার অভাব।  পরিবহন শ্রমিক, মালিক, সংগঠনের মধ্যে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে যারা নীতি নির্ধারণী হিসেবে কাজ করছেন তারাই আবার মালিক শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছেন। ফলে কৈফিয়াতের জায়গাটা কমে গেছে। আর এর ফলে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

দেশে সড়কের এই নৈরাজ্যর মধ্যেই আমরা বুলগেরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যাওয়ায় তিন মন্ত্রীর পদত্যাগের খবর পায়।সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশটির পরিবহনমন্ত্রী ইবাইলো মসকোভস্কি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভেলেনটিন রেদভ এবং আঞ্চলিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী নিকোলয় নানকভকে বরখাস্ত করেছেন বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বয়কো বারিসভ।

তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁদের দায় নিতে হবে। অন্যদিকে পরিবহনমন্ত্রী ইবাইলো দুর্ঘটনার নৈতিক দায় গ্রহণ করে বলেছেন, ‘এ ঘটনার সমস্ত রাজনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে আমরা সরে যাচ্ছি। আমাদের অবশ্যই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল।’

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় পদত্যাগ, বরখাস্তের কোন ঘটনা দেশের মানুষ দেখতে চায় না। দেশের মানুষ দেখতে চায়, সড়কের এই নৈরাজ্য বন্ধ হোক। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত আছেন সরকারের দুজন মন্ত্রী। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ আর উদ্যোগ নিলেও সেটা খুব একটা কাজ হয়নি সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা তারই  চিত্র।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন করা, বিরতিহীনভাবে যানবাহন চালানো, অপ্রাপ্তবয়স্ক  ও অদক্ষ চালক-হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, সড়ক-মহাসড়কে ফুটপাত না থাকা ও  সড়ক-মহাসড়কে বেহাল দশা বাংলাদেশে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।

দুর্নীতি বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির জাতীয় খানা জরিপ-২০১৮ তে দেশে দ্বিতীয় দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে বিআরটিএ অর্থাৎ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের নাম।

দেশে যখন সড়কের নৈরাজ্য থামছে না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে যখন প্রতিদিন প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে তখন টিআইবির এই জরিপ যে পুরোপুরি সঠিক সেটা সহজেই অনুমেয়।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেমন পিঁপড়াও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। তেমনি সড়কের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সড়ক ব্যবস্থার বেহাল দশার কথা। সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে আকিফার মতো মায়ের কোলে থাকা শিশুর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিই এখন সবার। আকিফা, পায়েল, আমানুল্লাহ, রেজাউল করিমরা সড়কে রক্ত দিয়ে সড়কের এই নৈরাজ্যর বিরুদ্ধে যেন প্রতিবাদ করেছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে পারলেই হয়ত শান্তি পাবে তাদের আত্মা। না হয় ওরা আমাদের ক্ষমা করবে না।

Bootstrap Image Preview