Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

ট্রাম্পের লাল কার্ড ও গণমাধ্যম

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:১২ AM
আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১০:১৬ AM

bdmorning Image Preview


আল-আমিন হুসাইন

‘‘if he had to choose between a government without newspapers or newspapers without a government, I should not hesitate a moment to prefer the latter’’.  কথাটির বাংলা করলে দাড়ায়   ‘‘আমাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার ও সরকারবিহীন সংবাদপত্র-এই দুইয়ের মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি পরেরটিই অর্থ্যৎ সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেব। কথাটি বলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার ও  আমেরিকার ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’ -এর প্রধান প্রণেতা টমাস জেফারসন।

১৭৮৭ সালে টমাস  জেফারসনের বন্ধুকে লেখা এই চিঠিটি সম্প্রতি সময়ে নতুন করে আবার সামনে নিয়ে এসেছে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। গত মাসেই প্রকাশিত পত্রিকাটির এক নিবন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্যাম্পের গণমাধ্যমবিরোধী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথা মনে করিয়ে দেয়া হয় হাল আমলের প্রেসিডেন্টকে।

গণমাধ্যমের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকা জেফারসন সেসময় তার বন্ধুকে চিঠিতে আরও লিখেছিলেন, ‘‘জনগণই হচ্ছে শাসকদের সেন্সর। সংবাদপত্রে সরকারের ভুলত্রুটি সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা পড়ে। আর সরকার চাইলে সে ভুল সহজেই শোধরাতে পারে।’’

জেফারসন তার সেই বক্তব্যে গণমাধ্যমকে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে দেখেছিলেন। তবে সেই তিনিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর আর গণমাধ্যমকে বন্ধু ভাবতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার সুর ছিল, ‘‘সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোন কিছুই আর বিশ্বাস করা যায় না। কারণ সংবাদপত্রে ছাপা হওয়ামাত্রই সত্য আর সত্য থাকে না।’’

তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমেরিকার দায়িত্ব নেয়ার সময় গণমাধ্যমের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এমন ছিল। তবে হাল আমলের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরু থেকেই সরাসরিভাবে গণমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে আসছেন। ট্রাম্পের কারণে আজ বিশ্বব্যাপী ‘ফেক নিউজ’ নামের সংবাদ প্রকাকরণ বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। যখনই তার মিথ্যা দাবির বিষয়ে গণমাধ্যম সত্য প্রচার করছে। তখন থেকেই ঢালাওভাবে গণমাধ্যমের সংবাদকে ‘ফেক নিউজ’ আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন।

প্রচণ্ড আত্মাভিমানী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার দিন দাবি করেছিলেন, তাঁর পূর্বসূরী বারাক ওবামার শপথ অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি লোক সমাগম হয়েছে তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে। আগে থেকেই বির্তক থাকা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই দাবির পরই দেশটির গণমাধ্যম এই দুই প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানের ছবি পাশাপাশি দিয়ে ট্রাম্পের অসত্য দাবিটি দেখিয়ে দিয়েছে। এরপরই নিজের ‍বিরুদ্ধে যেকোন সমালোচনাকে তিনি ‘ফেক নিউজের’ অধীনে ফেলে দিচ্ছেন।

টমাস জেফারসন যেখানে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘সংবাদপত্রে সরকারের ভুলত্রুটি সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা পড়ে। আর সরকার চাইলে সে ভুল সহজেই শোধরাতে পারে।’’ সেই জেফারসনের আসনে ব্যবসায়ী থেকে হঠাৎ প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া ট্রাম্প কিন্তু মোটেই জেফারসনের পথ অনুসরণ করলেন না। যখনই তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাগণ কোন বিষয়ে সমালোচনা করেছেন তার ভাগ্যে জুটেছে ‘ইউ আর ফায়ারড’ বা বরখাস্ত। সমালোচনা সহ্য করতে না পারায় হোয়াইট হাউস ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে একের পর এক বরখাস্ত করে চলেছেন তিনি।

নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই সেই সংবাদকে, গণমাধ্যমকে তিনি টুইট করে ফেক নিউজ বা ভুয়া খবর বলে আথ্যা দিয়েছেন। এই পর্যন্ত কয়েক’শ বার তিনি ‘ফেক নিউজ’ শব্দটি টুইট করেছেন। গণমাধ্যমকে শত্রুভাবা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে সে দেশের সংবাদমাধ্যম। ট্রাম্পের বিষেদাগারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশটির  ‘দ্য বোস্টন গ্লোব’  পত্রিকা ‘হ্যাশট্যাগ এনিমিঅবনান’ ডাক দেয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, গণমাধ্যম একযোগে ট্রাম্পের এই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধাচারণের বিপক্ষে সম্পাদকীয় লিখবে।

১৬ আগস্ট বোস্টন গ্লোব, ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানসহ যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় ও জাতীয় প্রায় ৩৫০টি সংবাদমাধ্যম একযোগে বিভিন্ন শিরোনামে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। গণমাধ্যমের যখন বিশ্বব্যাপী কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা অব্যাহত সারাবিশ্বে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে বিভাজন যখন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন একযোগে ট্রাম্পের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে একযোগে সমালোচনা করা একটা পজিটিভ দিক।

সম্প্রতি সার্চ ইঞ্জিন গুগলকেও এক হাত নিয়েছেন ট্রাম্প। গুগলে সার্চ দিলেই নাকি ট্রাম্পের ভুয়া সংবাদই বেশি আসছে। তাতেই চটে যান ট্রাম্প।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের এককাট্টার পরও থেমে থাকেনটি ট্রাম্প। কিছুদিন আগেই তিনি গণমাধ্যমকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা জানি ফুটবল খেলায় খেলোযাড়দের নিয়ন্ত্রণে লাল কার্ড- হলুদ কার্ড ব্যবহার হয়। ফাউল করলে খেলোয়াড়কে সতর্ক করার জন্য হলুদ কার্ড আর সিরিয়াস ধরণের ফাউল করে বসলে মাঠ থেকে বেড়িয়ে যাবার জন্য লাল কার্ড দেখানো হয়।

ট্রাম্প সাংবাদিকদের মজার ছলে লাল কার্ড দেখানোর সুযোগটাও পেয়েছেন ফুটবল খেলার জন্য। কানাডা ও মেক্সিকোর সাথে যৌথভাবে ২০২৬ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে আলোচনা করতে হোয়াইট হাউসে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের আমন্ত্রণে খালি হাতে যাননি ফিফা সভাপতি। সাথে নিয়ে গেছেন, ট্রাম্পের জন্য  জার্সি, লাল এবং হলুদ কার্ড। আর সেই সুযোগ পেয়ে সরাসরি মিডিয়ার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ট্রাম্প সাংবাদিকদের লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন।

উপহার হিসেবে ফিফা সভাপতি থেকে হলুদ কার্ড পেলেও সেটার ব্যবহার করেননি ট্রাম্প। ট্রাম্পকে আগেই ফিফা সভাপতি বলেছিলেন, ‘হলুদ কার্ডটা সতর্ক করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আর লাল কার্ড সরাসরি বের করে দেয়ার জন্য। তাহলে কী ট্রাম্প রসিকতার ছলে গণমাধ্যমকে বের হরে দিলেন। সেটা ট্রাম্প হয়তো ভালো বলতে পারবেন। তবে যেহেতু তিনি একজন আপাদমস্তক কমেডিয়ান ছিলেন। তাই লাল কার্ড দেখানোটা মজা হিসেবে নেয়া যেতো যদি তিনি শুরু থেকেই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধাচারণ না করতেন।

তবে শুধু ট্রাম্প নয় পৃথিবীর সব দেশে কমবেশি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান বা করেন ক্ষমতাসীনরা। নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে, ভিন্নমত বন্ধ করতে, নিজেদের জনপ্রিয়তা যাতে কোনভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয় সেই কারণেই গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, তুরস্কর মতো ক্ষমতাশীন দেশগুলো ছাড়াও সারাবিশ্বে গণমাধ্যমকে অনেক শক্তভাবে দমন করা হচ্ছে। এসব দেশের গণমাধ্যমকে কোনভাবেই সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করা যায় না। করলেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়।

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গণমাধ্যমকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়। বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কথা থাকলেও আমরা দেখি যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

সম্প্রতি দেশের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কয়েকজন সাংবাদিককে রাস্তায় নির্মমভাবে পেটানো হয়। এর আগেও পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হতে দেখা গেছে।

এছাড়া ওই আন্দোলনে আমরা গুজব নামের একধরনের সংবাদের সাথে পরিচিত হয়েছি। গুজব হল আমেরিকান ইংরেজিতে rumorবা ব্রিটিশ ইংরেজিতে rumour;অর্থ হল, জনসাধারনের সম্পর্কিত যেকোন বিষয়, ঘটনা বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত কোন বর্ণনা বা গল্প। আর সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হল এমন কোন বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনই নিশ্চত করা সম্ভব হয় না। আর বর্তমান সময়ে গুজব মুখে মুখে না ছড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে ছড়ায়।

মানুষের তথ্য পাওয়ার আকাঙক্ষা এক ধরনের চাহিদা। যেকোন বড় ঘটনা বা দুর্ঘটনায় মানুষ তথ্য পেতে চায়। আর সেই তথ্যের জন্য মানুষ শরণাপন্ন হয় গণমাধ্যমের। কিন্তু যখন সেই গণমাধ্যমে তথ্য না পায়। তখনই মানুষ তথ্য পেতে বিকল্প উপায় খোঁজ করে।  আর সেই সুযোগ গ্রহণ করে স্বার্থান্বেষী মহল। তারাই তখন গুজব ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। ফলে যেকোন দুর্ঘটনা বা ঘটনায় জনগণকে সঠিক তথ্য দিতে সহযোগিতা করতে  হবে সরকারকে। কারণ তথ্য না মিললে মানুষ তখন গুজবের পিছনে ছুটবে।

সংবাদপত্রকে একটি দেশের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। দেশ পরিচালনায় সরকারকে সহায়তা করে গণমাধ্যম। সরকারের বিভিন্নভাগের মধ্যে তথ্য পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটাও রাখে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম আর সরকার কেউ কারো শত্রু নয়। ফলে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সরকারকে, রাষ্ট্রকে তথ্য প্রচারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। সঠিক তথ্যে প্রচার করলে গণমাধ্যমকে পুরস্কৃত করবে, ভুল সংবাদ প্রচারে তিরস্কার করবে। কিন্তু ট্রাম্পের ন্যায় ভুয়া সংবাদ নামে গণমাধ্যমের সমালোচনা কখনোই কাম্য নয়। মানুষ যেমন গুজব তথ্য পেতে চায় না, তেমনি তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতেও চায় না।

Bootstrap Image Preview